ঐ আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে রব
তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হব ।
কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ?
চির জনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো,
অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব,
.......
সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব,
তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হব
তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হব ।
কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ?
চির জনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো,
অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব,
.......
সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব,
তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হব
মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট আরো একবার ছুঁয়ে গেল আমার মন । মনে হল ভারতবর্ষের এই একটি জায়াগা এখন ও একবিংশ শতকের দ্রৌপদী, সীতা এবং সর্বোপরি আমার মত অসংখ্য গৃহবধূর জন্য খুলে রেখেছে তার দরজা, ঐ আসনতলে স্থান দিয়েছে তাদের শক্ত করে ।তবু ও তো একটা দিন এল যেদিন এই অবলা গৃহবধূদের কথা খবরের কাগজে টপিক হিসেবে স্থান পেল ।অবিশ্যি এর মূলে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের গৃহবধূ রেণু আগরওয়ালের রোড একসিডেন্টে মৃত্যু। তাই তার স্বামী অরুণ আগরওয়াল আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির থেকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ১৯.২ লক্ষ টাকা দাবী করেন আজ থেকে কয়েক বছর আগে ।এলাহাবাদ হাইকোর্ট, এবং মোটর একসিডেন্ট ক্লেম ট্রাইব্যুনাল সেটি মেনে নিল না এবং তখনই শুরু গৃহবধূ ওরফে হোমমেকার চ্যাপটার । একজন গৃহবধূর ন্যাজ্য মূল্য কি হতে পারে এবং যেহেতু সে সংসারে আয় করেনা তাহলে তার আদৌ কোনো অবদান আছে কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠল । The Motor Vehicles Act, 1988 অনুযায়ী রোড একসিডেন্ট হলে একজন হোমমেকার এর প্রাপ্য টাকার অঙ্ক হল তার স্বামীর রোজগারের এক তৃতীয়াংশ । এটি একটি ঐচ্ছিক বা arbitrary অঙ্ক । তাই যদি হয় তাহলে একটা গৃহবধূর প্রাণের মূল্য বা net present value
(NPV) আমরা ক্যালকুলেট করতেই পারি । আর একজন হোমমেকারের income potential এই ভাবে বিচার করা যেতেই পারে । কিন্তু যে এমএসসি পাশ মহিলা হোমমেকার তার স্বামী যদি স্বল্প শিক্ষিত হয়ে সামান্য বেতনের কাজ করেন তাহলে ও কি তাঁর স্ত্রীর প্রাণের মূল্য ঐ একইভাবে ক্যালকুলেট করা হবে ? সুতরাং এরূপ একটি ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা করা উচিত । সময় এসেছে যখন পার্লামেন্ট চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে এই হোমমেকারের সঠিক মূল্য
কত হওয়া উচিত আর সংসারে তার অবদান কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে একটি ন্যাজ্য মাপকাঠিতে তার জন্য একটি পেরোল স্ট্রাকচার খাড়া করার । তাহলে রেণুর মত কোনো গৃহবধূর পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলে তার স্বামী যাতে ন্যাজ্যমূল্যের অঙ্কটি ক্ষতিপূরণ রূপে পান ।অন্যথায় সেন্সস 2001 অনুযায়ী ৩৬কোটি এরূপ গৃহবধূকে ভিখারি, বারবণিতা , এবং বন্দীর সাথে একই আসনে রাখা হয়েছে কারণ এই চারটি দল নাকি অকর্মার ঢেঁকি এবং দেশের nonproductive population এর মধ্যে পড়ে তারা । কিন্তু ন্যক্কারজনক এই উক্তির অবতারণা করে আবারো বলি, এই গৃহবধূ বা গালভরা নামের হোমমেকারটি তাহলে রইলেন অবহেলিতা , স্থান পেলেন না সেই আসনতলে? পেলেন না তাঁর কাজের প্রাপ্য মূল্য ।
ভিখারী দেশের অর্থনীতিতে কিছু contribute করেনা । কিন্তু ভিখারি হোমমেকারটি তার লোটা-কম্বল সম্বল করে ফুটপাথের স্নিগ্ধ সুশীতল ছায়াতরুতলে লালন করেন তার সংসার । তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাটুকু কে দেবেন ? বন্দী, সেও তো অর্থনীতিতে এক নয়া পয়সা contribute করে না বরং উল্টে তার জন্য সরকারের প্রচুর টাকা ব্যয় হয় । বারবণিতা , তাঁকে তো আমি আর পাঁচটা স্টেজ পারফর্মারের পর্যায়ে ফেলি কারণ সে তো মনোরঞ্জন করছে জনতার । সে সমাজে না থাকলে আজ ঘরের মেয়ে বৌদের রাস্তায় টেনে আনা হত । সে নৈতিক না অনৈতিক কাজ করছে সেটা আলোচনার বিষয় বস্তু নয় কিন্তু সে প্রোডাক্টিভিটি বা উত্পাদনে তথা দেশের জিডিপিতে পরোক্ষভাবে কিছু contribute করছে । তাকে আন-প্রোডাক্টিভ বললে তো সিগারেট বা লিকার মার্চেন্টদেরও সেই পর্যায়ে ফেলতে হয় ।
এদের সাথে হোমমেকারকে পঙতিভোজনে বসাতেই হল? একজন হোমমেকারের কি তাহলে দেশের গ্রস ডোমেষ্টিক প্রোডাক্টে অবদান শূন্য ? এবার বলি "শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত"; তা বলি এই শিশুদের দশমাস দশদিন নিজের জঠরে ধারণ করে, তার পর জন্মথেকে সাথে সাথে মায়ের স্নেহটি দিয়ে লালন করেন সেই হোম মেকারটি । আবার তাকে স্কুলের জন্য তৈরী করে, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তাকে কত টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে মানুষ করেন কে শুনি ? বাড়িতে কাজের লোক না এলে , বাড়ির সব লোকের দেখাশুনো করা থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোনবিল জমা দেওয়া, ডাক্তার ডাকা, প্রত্যেক সদস্যের জন্য কাস্টমাইজড সার্ভিস দেন এই হোমমেকারটি । কথায় বলে "খুজরো কাজের মুজরো নেই " সেভাবেই গৃহবধূদের কাজের কোনো দাম দেওয়া হয়না । আমি এও অনেককে বলতে শুনেছি " বাড়িতে থাকো, কি আর কর, আমাদের মত দশটা-পাঁচটা তো আর করতে হয়না" বা "বুঝতে ঠেলা যদি বাইরে বেরোতে হত, তুমি আর কি কর, রান্না ? সে কাজ তো সবাই পারে" এক শাশুড়িমা কে বলতে শুনেছি, তার ছেলে বৌমা দুজনেই চাকরী করতে চলে যায় একমাত্র কন্যাকে তাঁর জিম্মায় রেখে । রাতে বাড়ি ফিরে সুস্বাদু সব পদও তিনি রেঁধে রাখেন ..নাতনীটির স্কুলের হ্যাপা, স্নান খাওয়া সবকিছুই তাঁর দেখতে হয় কিন্তু তবুও তিনি কোনো রেকগনিশন পাননা বলে খুব দুঃখ করেন |
অতএব মহামান্য সুপ্রিমকোর্টকে ধন্যবাদ ! হোমমেকার বা হাউস ওয়াইফটিকে এবং তার দৈনন্দীন কৃতকর্মের জন্য তাকে অর্থনৈতিক ভাবে উতপাদনশীল বলে আখ্যা দেবার জন্য । নয়ত তারা কেবলই দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দায়টি মাথায় তুলে নিয়ে তাদের উতপাদনশীলতার মুকুট পরে বসে থাকত আজন্মকাল । একটি কোম্পানির সারাবছরের হিসাবের খাতাটিকে বলে এনুয়াল রিপোর্ট যেখানে দুটি টেবল থাকে একটি ব্যালেন্সড শিট অন্যটি লাভ-ক্ষতির হিসাব; তাহলে আমি বলব এই হোমমেকারটি সেই দেশের অর্থনৈতিক হিসাবের খাতায় ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতিপালন করে জাতীয় সম্পদ বা capital asset তৈরী করছেন ; চুলোয় যাক বাসন মাজা, ঘরপোঁছা, রান্না করা । লাভ-ক্ষতির একাউন্টে তাকে না আনাই শ্রেয় । তিল তিল করে সঞ্চিত হচ্ছে সেই সব ধনরত্ন সেই শিশু নাগরিকের মধ্যে । যার মধ্যে থেকেই কেউ গিয়ে নাসায় রকেট চড়ছে, কেউ জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী করছে, কেউ বানাচ্ছে অটোমোবাইল, কেউ বা হচ্ছে সৌরভ, লিয়েন্ডার-বিশ্বনাথনের মত কিম্বা রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের মত নোবেল লরিয়েট !
এই সেই মহিলা যিনি ভোর থেকে রাত্রি পর্যন্ত সংসারের স্টিয়ারিংটি হাতে নিয়ে সংসারটিকে চালনা না করতেন তাহলে জানিনা কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াত । তাঁর প্রতিপক্ষ বলবে কারোর জন্য কারোর আটকায় না কিন্তু আমি বলব যতক্ষণ দাঁত থাকে ততক্ষণ দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না । বাড়ির যে খরচাগুলি সেই মহিলা বাঁচান সেগুলি কিন্তু ততটাই টাকা রোজগারের সমতুল্য । আমেরিকার একটি সংস্থা National Network For Women Employment সেই সব গৃহস্থালী কাজকর্মের রোজকার হিসাবের অঙ্কটি কষে দেখিয়েছে যেখানে একজন আমেরিকান হাউস ওয়াইফের opportunity cost অর্থাত রোজগারের সুযোগ ত্যাগ করার মূল্য হয় বছরে ৩০০০০ ডলার ।
আমাদের দেশে তা অনেকটাই কম কারণ আমাদের দেশে বাড়িতে কাজ কর্ম করার লোক পাওয়া যায় । তবে এও দেখেছি ছেলেপুলে মানুষ করার জন্য বা দেখা শুনো করার জন্য এদেশ থেকে মা বাবা কেও নিয়ে যাওয়া হয় । তখন আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করি একজন মা বা ন্যানির কি ভূমিকা । তাই একজন গৃহবধূ বা হোমমেকার একাধারে মা একাধারে স্ত্রী পুত্রবধূ আবার কখোনো বা ন্যানির কাজ ও করেন, একি পয়সায় হিসেব করা যায় । আজীবন কাল ধরে প্রতিটি পরিবারের গৃহবধূরা যে কর্তব্যপালনের কাজ করে চলেছেন তার মূল্য অর্থ দিয়ে না দিয়ে ও একটু স্বীকৃতি দিলেও বুঝি গৃহবধূরা যারপরনাই খুশি হবেন । আর আইনের মাধ্যমে তাদের কাজের মূল্যায়ন এবং যে ভাবে জনগণনা কর্তৃপক্ষের প্রতি কটাক্ষ করেছেন মহামান্য আদালত তা দেখে মনে হয় উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত ! জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা !
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে গৃহবধূটি কিন্তু সেই প্রতিবাদে সোচ্চারিত নন আর তার "take it for granted" এর মতই চুপচাপ বসে রইলেন জন্মজন্মান্তকাল ধরে । আর মা টি সেই রোজকারের ব্যস্ততায় ছেলের জ্বরে মাথায় জলপটিতে ওডিকোলন, নুন-হলুদ মাখা আঁচলে পোঁছেন মেয়ের টিফিনকৌটোটি, স্বামীর ওয়ালেট্, রুমাল, কলম হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন অফিসের তাড়ায়, তারপর বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোন ইলেকট্রিক, টেলিফোন বিল, গ্যাসের খবর আর এটিএম মেশিনের লাইনে ।
আমার অসংখ্য ধন্যবাদ "তারা নিউজ" চ্যানেলটিকে ! একটি সর্বভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং পরিষেবার মাধ্যমে "আজকের সুবর্ণলতা" অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই বিষয়টি সকলের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য ! একটি এক ঘন্টার লাইভ-শো তে আমার সাথে প্রোগ্রামের হোস্ট ছিলেন মৌমিতা তারণ ।