২৭ জানু, ২০২৪

প.ব মৎস্য দফতরের সিনিয়র স্পেশ্যাল সেক্রেটরী অতনু রায় লিখলেন প্রফুল্ল রসায়নী নিয়ে



 

"প্রফুল্ল রসায়নী" 

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

মান্দাস 


রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের মেধাবী সহপাঠী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জীবনোপন্যাস "প্রফুল্ল রসায়নী" একখানি ঐতিহাসিক দলিল। উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি পাঠকের কাছে  সমসাময়িক বাঙলার ইতিহাস ও ভারতবর্ষে আধুনিক রসায়ন শিক্ষার ক্রমবিকাশ তুলে ধরেছেন। প্রফুল্লচন্দ্র এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন ভারতবর্ষে সবেমাত্র ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একশ বছরের অরাজকতার অবসানে ইংরেজদের রাণীর ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে।ইংরেজ তার সবচেয়ে সম্পদশালী উপনিবেশে শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা ভাবতে শুরু করেছে।অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার রাডুলি-কাটিপাড়া গ্রামে ১৮৬১ সালে এক প্রগতিশীল শিক্ষিত পরিবারে তাঁর জন্ম।পিতা হরিশচন্দ্র ছিলেন মুক্তমনা সুশিক্ষিত মানুষ।নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীনাথ বোসের এলবার্ট স্কুলের সহপাঠী এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিশেষ স্নেহধন্য। মা ভুবনমোহিনী বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে বাংলার পাঠ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।এমন বাবা মায়ের আদরে ও সান্নিধ্যে, পিতারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামের স্কুলে প্রফুল্লচন্দ্রের পড়াশোনা শুরু। মা ও বাবার সঙ্গে প্রফুল্লর সংলাপগুলি কাল্পনিক হলেও উপন্যাসে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। 

সন্তানের উচ্চতম শিক্ষার উদ্দেশ্যে হরিশচন্দ্র পরিবারসহ চলে এলেন কলকাতায়। বালক প্রফুল্লচন্দ্র প্রথমে হেয়ার স্কুল ও তারপর  এলবার্ট স্কুল থেকে বিদ্যালয় শিক্ষা শেষ করে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে এফ এ পড়তে ভর্তি হন।সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ। শুরু হলো ব্রিটিশ প্রফেসর আলেকজান্ডার পেডলারের তত্ত্বাবধানে রসায়ন শিক্ষা। পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দেয় প্রেসিডেন্সি কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাবের গল্প। আমরাও সেখানে কাজ করেছি। পরীক্ষা দিয়েছি। মেলাতে চেষ্টা করি। শিহরিত হই। 

অতঃপর গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে ১৮৮২ সালে বিলেতে পাড়ি। এসে পৌঁছলেন স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।বিলেতে পূর্ণ সান্নিধ্য ও সহযোগিতা পেলেন অগ্রজপ্রতিম জগদীশ চন্দ্র বসুর। প্রেসিডেন্সির সিনিয়র 'জগদীশদা'র সঙ্গে ছাত্র প্রফুল্লর সংলাপ  চমৎকার সুখপাঠ্য। 

এডিনবার্গে তাঁর শিক্ষক ছিলেন লন্ডন ইউনিভারসিটির প্রথম ডিএসসি ডিগ্রিধারী প্রফেসর আলেকজান্ডার ক্রাম ব্রাউন।১৮৮৫ সালে বিএসসি ডিগ্রি লাভ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় ডাক পাওয়া।কনজুগেটেড সালফেট নিয়ে তাঁর গবেষণা এবং মাত্র দু বছরে ১৮৮৭ সালে একসঙ্গে ডিএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ।১৮৮৮ সালে দেশে ফিরে এলেন। এবারও তাঁকে  স্বাগত জানাতে উপস্থিত সস্ত্রীক জগদীশ চন্দ্র।প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে ১৮৮৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতায় যোগদান।একদিকে রসায়নের ল্যাবরেটরিতে অনলস গবেষণাকার্য ও অপর দিকে স্বজাতিকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান ও শিল্পের সংমিশ্রণ ঘটানোর অনাবিল প্রচেষ্টা।১৮৯২ সালে আপার সার্কুলার রোডের নিজের ভাড়াবাড়িতে তাঁর স্বপ্নের বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের ভিত্তি স্থাপন।১৮৯৫ সালে তাঁর মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার তাঁকে বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত করে তোলে।১৯০২ সালে তাঁর রচিত গবেষণাপত্র A History of Hindu Chemistry Part-1 ইউরোপ ও আমেরিকার মত এশিয়া খন্ডেও বিজ্ঞানের সার্বভৌম চর্চা সম্মন্ধে তৎকালীন বিশ্বকে অবগত করে।১৯০৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্রর সুযোগ হয় দ্বিতীয় দফা স্বল্পকালের ইউরোপ ভ্রমণের। এবার তিনি নব্য রসায়নশাস্ত্রের পীঠস্থান প্যারীসেও আসেন এবং সাক্ষাৎ হয় রসায়নের ঋষি বার্থেলোর সঙ্গে। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালে হিন্দু রসায়ন বইটির দ্বিতীয় খন্ডটি তিনি বার্থেলোকেই উৎসর্গ করেন।১৯০৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর দীর্ঘ দিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অনুরোধে প্রফুল্লচন্দ্র ১৯১৬ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স বা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে যোগ দেন। ইংরেজ সরকারের কোন সাহায্য ছাড়াই আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের দানে ১৯১৪ সালে এই কলেজ স্থাপিত হয়।

নিজে বড়লোকের ঘরের ছেলে হয়েও দরিদ্র সংস্কারাচ্ছন্ন দেশবাসীর প্রতি তাঁর হৃদয়ের ভালোবাসাই বোধহয় তাঁকে পরাধীন ভারতে অজস্র প্রতিকুলতার মধ্যেও কিছু অসম্ভব কর্মসাধন করতে সাহায্য করেছিল।তিনি বেঙ্গল কেমিক্যাল এর মত রাসায়নিক কারখানা তৈরিতে সফল হলেন।আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাত ধরে পরাধীন ভারতবাসীর রসায়ন চর্চা কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দিল যেদিন বেঙ্গল কেমিক্যাল এর উৎপন্ন বস্তু BP (British Pharmacopeia) লেভেল পেল।অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ১৯৪০ সালে কোম্পানীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে স্বেচ্ছায় কোম্পানী ছেড়ে চলে আসেন।ভাষা সাহিত্য বিজ্ঞান পরিবেশ সমাজসেবা সকল বিষয়েই তাঁর আগ্রহ ছিল অসামান্য।উপন্যাসের মাধ্যমে সমকালীন প্রায় সকল বিখ্যাত বাঙালির সঙ্গেই তাঁর হৃদয়ের যোগাযোগ দেখতে পাই।অগ্রজপ্রতিম জগদীশ চন্দ্র বসু ও সমবয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ছিল তাঁর আজীবন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।জানতে পারি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, ডঃ নীলরতন সরকার, ডঃ রাধাগোবিন্দ কর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র ও গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক।বইয়ে তৎকালীন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের শ্রেষ্ঠ ছাত্রগণ সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা, সি ভি রমন, রাজশেখর বসু প্রমুখের প্রসঙ্গ উঠে এল। যেগুলি বইটিকে আরো মনোজ্ঞ করে তুলেছে। ছোটোবেলায় মনীষিদের জীবন নিয়ে আমাদের বাংলা রচনা লিখতে বলা হত। কিন্তু এ জীবনীভিত্তিক উপন্যাস আরো অনেককিছু বলবে। আজীবন আচার্য'র জীবন যুদ্ধ তাঁকে কেমন করে নিরলস কর্ম তাপস করে তুলেছিল তা পড়ে ভাবতে হবে পাঠককে। 

আচার্যের জীবন অবলম্বনে এই উপন্যাস যার মধ্যে সমসাময়িক বাঙলার ইতিহাস ও ভারতবর্ষের আধুনিক রসায়ন চর্চার ক্রমবিকাশ প্রোথিত। স্বল্পমূল্যের এই বইটি স্কুল কলেজের লাইব্রেরীতে স্থান পাওয়ার যোগ্য।ব্যক্তিগতভাবেও এটি সংগ্রহের তালিকায় আসতে পারে। বিশেষত, অধুনা বঙ্গ সমাজে যখন parenting একটা issue, আচার্যের অভিবাবকদের প্রতি সন্তানের শিক্ষা সম্মন্ধে উপদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।রসায়ন শিক্ষায় যুক্ত বিশিষ্টজনদের কাছে বইটি কদর পাবে বলে বিশ্বাস রাখি।

লেখকের রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের সহপাঠী  অতনু রায় (সিনিয়র স্পেশ্যাল সেক্রেটরীমৎস্য দফতর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার) রিভিউ লিখলেন 

কোন মন্তব্য নেই: