৭ মে, ২০২১

আমার কোভিডদিন

 আজ ১৪ দিন আটতলার ঘরে বন্ধ। প্রচুর আলো, হাওয়া। পাখির ডাক। সবুজ গাছপালা। তবু আমি বড় নিঃস্ব যেন। হঠাত কাল্পনিক এক কথোপকথন এসে আজ দুপুরে ভর করল আমায়। এ ক'দিনে নিজেকে চণ্ডালিকার মত অছ্যুত মনে হয়। যদিও তা মানুষের মনগড়া জাতপাত।আমার প্রিয় চরিত্র চিরকালের। খুব ইচ্ছে হত চণ্ডালিকা হতে। বিশেষ করে ওর টপ নট আর কাঁচুলি, হাঁটুর ওপরে শাড়ি, ওপর হাতে তাগা। পায়ে মল। তাইই হয়েছি যেন বেশ কিছুদিনের জন্য। 

সেই সঙ্গে ঘুমের ঘোরে শ্রীচৈতন্যের বুকে টেনে নেওয়া যবন হরিদাসের মুখটা মনে পড়ল একবার। আমার দরজার বাইরে রাখা টেবিলে আমার চায়ের কাপে চা ঢেলে দেয় ওরা। প্লেটে রেখে যায় খাবার ও দাবার।


ঘুমের ঘোরে মা শুধালেন, কি হয়েছে তোমার? সারাদিন একলাটি পড়ে আছো কেন? চল, আমায় খেতে দেবে না? 

বললাম, মা, আমার সেই মারণ রোগ হয়েছে। এর থেকে মুক্তি পেতে আমায় এভাবেই থাকতে হবে। আমার ছোঁয়া কেউ খাবে না। আমার জামাকাপড় বাড়ির কারোর সঙ্গে কাচা যাবে না। আমার বাথরুম কেউ সরবে না। আমার পরম শ্রদ্ধেয় অমরজ্যতি কবিরাজ আর বন্ধু চিকিৎসক পুপুরাণীর বিধান। আমাকে শুনতেই হবে ওদের কথা। জানেন মা? ওরা ভীষণ কড়া। ওরাই আমার ঈশ্বর এখন। 


শাস্ত্রে বলছে, পৈত্তিকান্‌ সন্নিপাতজান্‌ কফবাতসমুদ্‌ভবান্‌—

ওসব রাখো তো। মা বললেন। 

কিন্তু মা, আমি তো ঠাণ্ডা লাগাই নি। 


অমর কোবরেজ বললেন, এই গ্রীষ্মকালীন রৌদ্র আর বায়ু দুই-ই ঐ নাকি আমার পক্ষে বিষবৎ— কারণ শাস্ত্রে বলছে, অপস্মারে জ্বরে কাশে কামলায়াং হলীমকে—


আমার শাস্ত্রের কড়া কড়া কথা শুনলে খুব ভয় করে মা। এসব শুনেই সেদিন আপনার ছেলে আমার ঘরের দরজা সেই যে বন্ধ করে দিল... 

আমি অমর কোবরেজ কে বলেছি, থাক্‌ থাক্‌, আপনার শাস্ত্র থাক্‌। আমার ওসব শুনলে বড় ভয় করে যে। 

তা সেই শুনে আপনার ছেলে আর কবিরাজ মশাই দুজনে যুক্তি করে বললেন, ওকে বন্ধ করেই রেখে দিতে হবে —অন্য কোনো উপায় নেই? মা বললেন। 

পুপুরাণীও ওদের তালে তাল দিল, জানেন মা? বলল যে রোগের যা নিয়ম। মানতেই হবে। কারণ, পবনে তপনে চৈব –

মা বললেন, ওরা কত বড় ডাক্তার বল! ওদের কথা তো শুনতেই হবে তোমাকে। আর তো মোটে ক'টা দিন। তা বলি, পথ্যি হচ্ছে তোমার? 

তার খামতি নেই । জল-ফল-প্রোটিন আবার জল। দুধ-ডিম-ডাল। আবার জল। কিন্তু আমার তো আর বন্দীদশা ভালো লাগছে না মা। 

আবার কবে আমরা যাদবের দোকানে যাব? আবার কবে পার্ক স্ট্রীটের সেই কোটাশাড়ির দোকানগুলোয় যাব? আবার কবে আমরা ক্যালকাটা ক্লাবে গিয়ে চা খেয়ে বেকারী তে ঢুঁ মারব? আমি আবার পারব তো যেতে? এসব করতে? আমি যে বড় দুর্বল আর হাক্লান্ত হয়ে গেছি মা।

কোন মন্তব্য নেই: