গতকাল ছিল আমার কোভিড একাদশী। জীবনে প্রথমবার আক্রান্ত আমার অতিমারীর অভিজ্ঞতা। অবশেষে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যেও লোহার বাসর ঘরে ঢুকে পড়ল মারণ ভাইরাস। তাই ভাববেন না খুব সতর্ক আছেন। আমার মত সাবধানে অনেকেই থাকেন না। তার একটাই কারণ ছিল ঘরে ৮৩ বছরের শাশুড়ি মা। একটু বেশী সতর্কই ছিলাম আমরা। তবুও কেউ হয়ত ঘরের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবেই দিয়ে গেছে এসে। সে নিজেও হয়ত জানত না যে সে চিহ্নহীন ধারক ও বাহক। এটাই এ রোগের সবচেয়ে মুশকিল। আমার গত ৫ই এপ্রিল প্রথম ভ্যাক্সিন নেওয়া হয়ে গেছিল। তারপর ভালো রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তারপরেও হয়ত শরীরে সাফিসিয়েন্ট এন্টিবডি তৈরী হয়নি। তার ফাঁকেই কেউ সেই মহামূল্য অমূল্যরতন মারণ ভাইরাস আমায় দান করে গেছিল। তেইশ তারিখ সকাল থেকেই জ্বর আসে। সঙ্গে শুকনো কাশি। গায়ে হাতে ব্যাথা। গতিক ভালো নয় দেখে নীচের থেকে প্রিলের পাউচ প্যাক, স্কচ ব্রাইট, নিজের ঘর থেকে গুচ্ছের নাইটি, হাউজকোট, পেটিকোট, ওষুধের বাক্স সব নিয়ে একটা ঘরে নিজেকে আইসোলেট করলাম আগেভাগেই। একটা পুরনো ঝ্যাঁটা, ঘর মোছার কাপড় সব নিলাম। মা তখনও বেঁচে। কি জানি আমি ওনার ঘরে যাচ্ছিনা, কেন, কি বৃত্তান্ত এসব ভাবছিলেন কি মনের মধ্যে? ওনার খাওয়া দাওয়া ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর থেকে ক্ষীণতম হয়ে গেল। এটা অবিশ্যি গত এক মাস ধরেই চলছিল। আমার তখন কাজ শুধু শুয়ে শুয়ে এক ঘণ্টা অন্তর অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপা। জ্বর বাড়তেই থাকল। রাতে ১০৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট উঠছিল। সারারাত ঘুম হয়না এ রোগে। শুধু প্রহর গুনে জেগে বসে থাকা ভোরের অপেক্ষায়। খুশখুশে কাশি তে ব্রেথলেসনেস যে কি কষ্টের হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। নাকে গন্ধ, স্বাদ, রুচি সব চলে গেল। বন্ধু ডাক্তার রা পাশে ছিল আমার। সেটাই একমাত্র আশার। খাওয়াটাই বড় চাপের হয়ে দাঁড়ালো। সোয়াব টেস্ট এর স্যাম্পেল নিল ২৫ শে। রিপোর্ট আসবে ৭২ ঘণ্টা পর। তার আগেই সিম্পটমস দেখে সবরকম ট্রিটমেন্ট শুরু করে দিলেন ডাক্তার বন্ধু। এর মাঝে মা দুম করে ২৮ তারিখ ব্রাহ্ম মুহূর্তে চলে গেলেন। ভাবলাম মায়ের সর্বক্ষণের মেয়েটি আছে। আমার খাবার নীচ থেকে ওপরে দিয়ে যাবে যেমন যাচ্ছে। পৃথ্বীশ কে ভাত জল দেবে। আমার ফল কাটাকুটি... আমার ঘর আমি কোনোমতে হাফাতে হাফাতে ঝাড়ু পোছা করে নিই। বাসন ধুয়ে নিই। সাতদিন অন্তর মেশিনে আমার জামাকাপড় কেচে নিয়ে মেলে দিই।
মেয়েটির বাড়ির লোক বোধহয় ভয় পাচ্ছিল। বুঝছিলাম ওর অস্থিরতা। সেই সঙ্গে তার তুমুল ভূতের ভয়। যেহেতু মা কে নাড়াচাড়া করত তাই। তার বাড়ি যাবার পিছটান বুঝলাম। ছেড়ে দিলাম তাকে। আমার জন্য তার যদি করোনা হয়? সেটাই তার বুঝি একমাত্র চিন্তা। এদিকে মুখে সকালে বিকেলে হরিরলুঠ চড়াচ্ছে সে আমার জন্য। ততদিনে আমার ১০ দিন হতে চলল। টেলিমেডিসিন এ ডাক্তার কন্সাল্টেশনও শুরু হল। রোজ একবার করে ফোন করেন ডায়েটিসিয়ান, ডাক্তার। কি খাচ্ছি, কেমন আছি। কি ওষুধ এইসব রুটিন ডায়ালগ। অশৌচ ডায়েট পালন করছিনা আমি। আমার শুধু ওষুধ হল খাওয়া। ইচ্ছে না করলেও । জল দিয়ে গিলে।
এভাবেই চলবে কোভিড একাদশী থেকে পূর্ণিমা। আবার ফিরবে অমাবস্যাও। ঠিক পেরিয়ে যাব একদিন। মাঝখানে মায়ের ডিজিটাল শ্রাদ্ধশান্তি আছে। মা আমার হাতে খেতে বড় ভালোবাসতেন। একটু হলেও সেদিন রান্না আমায় করে ওনার ছবির সামনে ধরতেই হবে আমাকে।
এখন নাকে গন্ধ এলেও মুখের রুচি ফেরেনি। শারীরিক দুর্বলতা যে কি জিনিষ তা বুঝছি নতুন করে। জীবনে ৬ বার মেজর সার্জারি হয়েছে। এমন কষ্ট উপভোগ হয়নি। কি জানি তখন বয়সটা কম ছিল বলেই হয়ত টের পায়নি। রক্তের জোর ছিল বলেই হয়ত অনুভূত হয়নি। যারা গতবছর "গোষ্ঠী সংক্রমণ" হয়েছে লিখেছিলুম বলে আমাকে রীতিমত ফেসবুকে ট্রোল করেছিলেন তারা এবছর সাবধানে থাকুন। এবারের স্ট্রেইন টা সত্যিই মারাত্মক। এত সাবধানে থেকে সেই গতবছর থেকেও "কোভিডচঞ্চু", "কোভিবিশারদ" এতসব গালভরা নামে আমায় ভূষিত করেছিলেন যারা? তারা জানলে খুশি হবেন এত সাবধানে থেকেও আমার ভাইরাল লোড বেশ মডারেট। তাই ফুসফুসের রিস্ক ফ্যাক্টর থেকেই যাচ্ছে। এ মারণ ভাইরাস একবার থাবা বসালে দগ্ধে দগ্ধে মারে। মানুষকে কাবু করে দিয়ে নিজে মজা দেখে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন