২৮ জুল, ২০১৫

অন্য অহল্যা

Photo Courtesy : Google
 ভিধানে অহল্যা শব্দটির অর্থ হলঃ লাঙল চালনার অযোগ্য এমন ভূমি  আর সংস্কৃতে ন-হলা বা যা হলকর্ষণযোগ্য নয় ।  এই অহল্যা নাম্নী নারীটি অযোনিসম্ভবা অর্থাত কোনো নারীর থেকে তার সৃষ্টি হয়নি।  সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নিজ হাতে গড়া  অমন তিলোত্তমা অন্য কোনো পুরুষের হয়ে উঠুক সেটিও বোধ হয় ব্রহ্মা মনেপ্রাণে মানতে পারেননি তাই বুঝি অহল্যা ছিলেন চিরকুমারী।  এবং সেখানেই তার  নামটি সার্থক। আবার অভিশপ্ত পাথরে রূপান্তরিত অহল্যা সত্য সত্য‌ই হলকর্ষণযোগ্য নয়  এবং নিষ্ফলা । সেদিক থেকেও নামের আক্ষরিক অর্থটির সাথে সাজুয্য রয়েছে।  

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সৃষ্ট অহল্যা নামে নারী চরিত্রটি পৌরাণিক উপাখ্যানে স্বনামধন্য হয়ে আছে অনেকগুলি কারণে।
১) তাঁর রূপ ( সৃষ্টিকর্তার খেয়াল  )
২) বুদ্ধি (বৃদ্ধস্বামীকে মানিয়ে নেওয়া ও এক‌ইসাথে দেবরাজ ইন্দ্রকেও খুশি করা) 
৩) বৃদ্ধ স্বামীকে মেনে নেওয়া  (পিতা ব্রহ্মার কথা লক্ষ্মী মেয়ের মত মেনে নেওয়া )
৪) অসাধারণ সিডিউসিং পাওয়ার  (বৃদ্ধ, যুবক সকলকেই পটিয়ে ফেলা )
৪)ইন্দ্রের সাথে পরকীয়ার কারণে অভিশপ্ত পাথরে রূপান্তরিত হয়ে প্রকৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে থেকে যাওয়া (চিরন্তন ভারত-নারীর ত্যাগ ) 
৫) রামায়ণের রামকে অতিথি সত্কারের দ্বারা অভিভূত করে অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া  (কঠোর তপস্যার জন্য, আর কিছুটা  গৌতমমুণির ক্ষমতা প্রদর্শণ) 
এবং এইসবগুলি কারণে পঞ্চকন্যার আখ্যা পাওয়া ।

"অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তদা, পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহা পাতক নাশনম্‌।।" 

এবার দেখি মূল অহল্যা-গৌতম-ইন্দ্র উপাখ্যান কি বলে ? 

 ব্রহ্মা যতগুলি মানসকন্যা সৃষ্টি করেছিলেন তার মধ্যে সর্বোত্কৃষ্টা এবং তিলোত্তমা ছিলেন এই অহল্যা।     সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নাকি স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশীর রূপের দেমাক খর্ব করার জন্য‌ই এই অবর্ণনীয় সুন্দরী অহল্যাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন। অহল্যা পেলেন ব্রহ্মার কাছ থেকে চিরযৌবনবতী থাকার আশীর্বাদ।
গৌতমমুণির কামনার স্বীকার হলেন যৌবনবতী অহল্যা। ধ্যানের বলে ব্রহ্মা জানতে পারলেন সে কথা।    কিন্তু ব্রহ্মা ঘোষণা করলেন, যে সারা পৃথিবী পরিক্রমা করে সর্বাগ্রে তাঁর সামনে আসবে তার সাথেই তিনি অহল্যার বিবাহ দেবেন। 
সেই কথা শুনে সমগ্র দেবকুল এবং মুণিঋষিরা সকলেই যাত্রা শুরু করলেন। যাত্রাশেষে আশ্রমে ফেরার মুখে মহর্ষি গৌতম একটি গোরুর বাছুর জন্ম নেওয়া লক্ষ্য করলেন। সেটি ছিল কামধেনু বা দৈব গোরু। সৃষ্টির এরূপ প্রকাশ লক্ষ্য করে গৌতম সেই গোবত্স্যের চারিপাশে প্রদক্ষিণ করে সেই পরিধির মধ্যিখানে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করলেন। 
ব্রহ্মা দৈববলে সে কথা জানতে পেরে গৌতমমুণিকে বললেন যে একটি গাভীর সন্তানের জন্ম দেওয়া হল পৃথিবী সহ সপ্তদ্বীপের উত্পত্তির সমতুল্য।  এবং সেই গোবত্স্যটি প্রদক্ষিণ করে তার মধ্যে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হল সারা পৃথিবী ভ্রমণের সমান। গৌতমের এরূপ কঠোর ধৈর্য দেখে ব্রহ্মার মন ভিজল।  তিনি গৌতমমুণির সাথে অহল্যার বিবাহে সায় দিলেন।  অসামান্যা সুন্দরী অহল্যা হলেন বৃদ্ধ গৌতম মুণির যুবতী ভার্যা। ব্রহ্মা নবদম্পতিকে উপহারস্বরূপ "ব্রহ্মগিরি" দান করলেন। ব্রহ্মগিরি  হল নবদম্পতির আশা আকাঙ্খা পূরণের সর্বোচ্চ স্থান।
বিবাহের পর ঈর্ষায় কাতর হলেন সমগ্র দেবকুল এবং মুণিঋষিরা। দেবরাজ ইন্দ্রেরো খুব রাগ হল । তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন অহল্যাকে। তখনি তিনি ফন্দী আঁটলেন মনে মনে। 
প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে গৌতমমুণি স্নান ও তপস্যার কারণে আশ্রমের বাইরে যেতেন।  দেবরাজ ইন্দ্র সেই সময় চন্দ্রের তপস্যা করে চন্দ্রকে বুঝিয়ে বললেন একটি মোরগের রূপ নিতে এবং গৌতমমুণিকে আরো ভোরে জাগিয়ে দিতে। সেদিন মোরগের ডাকে গৌতমমুণির ঘুম গেল ভেঙে। মোরগের ডাক শুনে গৌতম ভাবলেন ভোর হয়ে গেছে। তিনি আশ্রম থেকে নির্গত হলেন মাঝরাতে।

 দেবরাজ ইন্দ্র সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে অহল্যার কাছে এলেন   তাকে আহ্বান করলেন।  অহল্যা সম্মত হল।  যুবতী অহল্যা মহাখুশি। দেবরাজ ইন্দ্র সুদর্শন । বৃদ্ধ স্বামীর তরুণী পত্নীও যারপরনেই  দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরে মহাখুশি হলেন। শৃঙ্গার, সম্ভোগ পর্ব মিটতেই অহল্যা ইন্দ্রকে তখুনি চলে যেতে বললেন কারণ গৌতমমুণির আশ্রমে ফেরার সময় আসন্ন। 
নিজের ভোগলালসায় তৃপ্ত হয়ে ইন্দ্র সেই স্থান থেকে বেরিয়ে আসবার সময় গৌতমমুনির সাথে তার সাক্ষাত হয়ে গেল। গৌতম সব অবগত হলেন। তাই চন্দ্রে কলঙ্ক চিরস্থায়ী হয়ে গেল।   গৌতমমুণি অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে  বললেন,    "ছিঃ অহল্যা! আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তোমার রূপের দেমাক ধুলি ধূসরিত হল আজ থেকে। তোমাকে আমি চিরকালের মত অদৃশ্য করে দিলাম পৃথিবী থেকে। আজ থেকে সামান্য একটি পাথরে পরিণত হলে তুমি ।  যদি কখনো বিষ্ণু মনে করেন তিনি‌ই একমাত্র তোমাকে শাপমুক্ত করতে পারবেন।"

তাই বুঝি  ব্রহ্মা স্রষ্টা আর বিষ্ণু পালনকর্তা ।  ( Brahama, the Creator, Bishnu, the Preserver, Shiva, the Destroyer ).....  ভগবানদের মাহাত্ম্য কীর্তণে শুনতে পাই ।

অহল্যা হল প্রস্তর আর ইন্দ্র হলেন সহস্রযোনীপ্রাপ্ত এক তৃতীয় লিঙ্গের জীব। 

শোকে, অনুতাপে প্রকৃতির কোলে অহল্যা বেঁচে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। 
পরে রামায়ণে পাই রামকে তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ করে আর কঠোর তপস্যার দ্বারা অহল্যা শাপমুক্ত হন এবং পুনরায় মানবদেহ লাভ করেন। তাই অহল্যা পঞ্চকন্যার প্রথম স্থানে। 

ভীল উপজাতিদের রামায়ণে বলে  সপ্তর্ষিদের যজ্ঞাগ্নির ছাই থেকে উঠে এসেছিল অহল্যা।   ভাগবদ্‌পুরাণে বলে অহল্যা নাকি চন্দ্রবংশীয় রাজা মুদ্‌গলের কন্যা । 

 এ হল অহল্যা নিয়ে আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় উপাখ্যান। 

এবার আসল আলোকপাত "কহানী" খ্যাত পরিচালক সুজয় ঘোষের মাত্র ১৪ মিনিটের এপিক থ্রিলার "অহল্যা"র ওপর।
এও এক নতুন কহানী। কিছুটা  পুরাণকথা থেকে বেরিয়ে আবার কিছুটা তাকে রেখে দিয়ে। আর নামধাম অনুষঙ্গ সবকিছুই অটুট। ব্রহ্মা অনুপস্থিত এই অহল্যা কাহিনীতে কিন্তু গৌতম সাধু, ইন্দ্র সেন ও অহল্যা এই তিন মূল চরিত্র বেশ মিলেমিশে একাকার। এমনকি আর্টিষ্ট গৌতম সাধুর দেওয়া পরশপাথরটিও বেশ প্রতীকি। শিল্পী গৌতমের "বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা" অহল্যার সিডাকশান, পুলিশ ইন্সপেক্টর ইন্দ্র সেনের অহল্যার সাথে সেই শরীরিখেলায় মেতে ওঠা । অহল্যা গৌতমের সাথেও সাবলীল আবার তরুণ ইন্দ্রের (টোটা রায়চৌধুরী) সাথেও। রামায়ণ প্রসঙ্গ, পাথর অনুষঙ্গ, ঠিক আমাদের মূল উপাখ্যানের মত। কিন্তু যে ব্যক্তি হঠাত করে শিল্পীর কাছে আসেন আর ফিরে যান না তিনি। আর পাথর স্পর্শ করলেই তিনি পুতুলে পরিণত হন। সেটি বুঝি গৌতমমুণির অহল্যাকে অভিশাপ দেবার মত এক কঠিন শাস্তিপ্রদান। কিন্তু একটা খটকা থেকেই গেল। গৌতমরা  যুগে যুগে  তাঁর স্ত্রী অহল্যাকেই বারেবারে শাস্তি দিচ্ছেন এভাবে
কিন্তু কেন যে সুজয় ঘোষের অহল্যাকে "এপিক থ্রিলার" আখ্যা দেওয়া হল তা বুঝলামনা। অনবদ্য সৃষ্টি, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় প্রেক্ষাপট, দুর্দ্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি, আর সবচেয়ে ভালো মাত্র ১৪ মিনিটের মধ্যে একটা কিছুকে কংক্রীট দাঁড় করানো।   
ভাবতে কষ্ট হল এই ছবিতে গৌতম সাধু(সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)  বারেবারে তাঁর যুবতী স্ত্রীয়ের কাছে ঋণি থেকে গেলেন কারণ তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টির পেছনে নাকি তাঁর এই স্ত্রীরত্নটির অপরিসীম অবদান। আর তাই বুঝি বারেবারে অহল্যা (রাধিকা আপ্টে)  মোবাইলটি নীচে ফেলে চলে যায়। গৃহে কোনো আগন্তুক এলেই তাকে পাথর ছোঁবার অছিলায় বৃদ্ধ শিল্পী গৌতম সাধু সেই আগন্তুককে পুতুল বানিয়ে ফেলেন। সব কিছুই ঠিক ছিল যদিনা অহল্যার মূল কাহিনীর সাথে গুলিয়ে না ফেলি।
সব কিছুই ঠিক আছে তিনি সুজয় ঘোষ মহাশয় বলে। সবকিছুই ঠিক আছে যদিনা একজন ফেসবুক বন্ধু এই ছবিকে সত্যজিত রায়ের "প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুলের্" সাথে তুলনা না করতেন। তাহলে কি সুজয় ঘোষ "কপি পেস্ট" করলেন  কোন্‌টির থেকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)? পুরাণের গৌতমমুণি-অহল্যা-ইন্দ্রের গল্প থেকে না কি সত্যজিত রায়ের ঐ ছবিটি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে।
স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ভাবায় আমাদের সফল ছোটগল্পের মত। শেষ হয়েও যা শেষ হয়না।   ওহ্‌! আরেকটা কোশ্চেন! গৌতমমুণি সে যুগে স্ত্রীকে শাস্তি দিয়ে, অভিশাপ দিয়ে প্রস্তরীভূত করেছিলেন কারণ পরকীয়া।  এযুগের গৌতম সাধু বেশ মেনে নিয়েছেন তাঁর যুবতী স্ত্রীয়ের অন্য পুরুষকে সিডিউস করা, কিছুটা যেন উসকেই দিয়েছেন তাকে পরকীয়ায় মেতে উঠতে কারণ নিজের অক্ষমতা ( যা তিনি স্বীকার ও করেছেন ) ।  এইযুগে মোবাইল ফোন, ম্যাগাজিনে স্বাছন্দ্য আধুনিকা অহল্যাকে বর্তমানের গৌতম সাধু কিন্তু বেশ প্যামপার করেন। সেটাই যুগোপযোগী পরিবর্তন কিন্তু অহল্যা-গৌতম-ইন্দ্রের প্রত্যাবর্তন নয়। 



ও কলকাতা ব্লগজিনে প্রকাশিত