১০ ফেব, ২০১৪

ভীম-একাদশী


মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে দক্ষিণ বঙ্গের একটি বহুপ্রচলিত গ্রাম্যরীতি হল ভৈম-একাদশীর ব্রত পালন । মাহাভারতের ভীম এবং একাদশীর এই যোগসূত্র কি এবং কেন সেই নিয়ে এই আলোচনা । 
হিন্দুঘরের বিধবা কুন্তী নেয়েধুয়ে একাদশীর উপবাস করেন । মাঘমাসের প্রচন্ড ঠান্ডায় পুকুরের ঠান্ডাজলে কেমন করে স্নান করবেন তা ভেবে কুল পান না । কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেও ঐ ঠান্ডা জলে তাঁকে নামতে হ'ল । স্নান সেরে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কুন্তী ঘরের  দিকে আসছেন । তাঁর মধ্যমপুত্র ভীমের সাথে দেখা হল । ঠান্ডায় কাবু মা'কে দেখে শীতের ওপর ভীমের বড় রাগ হ'ল ।  সে তখন লাঙ্গল কাঁধে ক্ষেতে যাচ্ছিল । মায়ের কষ্টকে বরদাস্ত করবেন না তাঁর মত বড় বীর । ফাল থেকে লাঙ্গলকে খুলে নিয়ে আগুণে কশকশে করে গরম করে "জয় কৃষ্ণ" বলে সেই লাঙ্গলের ফালকে পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে দিলেন । আর দেখতে দেখতে শীত পালিয়ে গেল যেন । পান্ডবসখা কৃষ্ণ ভক্ত ভীমের মনস্কামনা পূর্ণ করলেন । হঠাত ভীম মায়ের দিকে চেয়ে দেখেন, কুন্তী খুব আরাম বোধ করছেন । 

এদিকে জলের দেবতা হলেন বরুণদেব ।  পুকুরের জলে আগুণ গরম লাঙলের ফাল ডুবিয়ে জলের গরম তাত সহ্য হয়নি একটুও । বরুণ সেই রাগে দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে দৌড়ে গেলেন পুকুরের জলের তাত জুড়োনোর আর্জি জানিয়ে । কৃষ্ণের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন বরুণদেব ।  কৃষ্ণের দয়া হল ।
কৃষ্ণ বললেন :  বরুণ তোমার গায়ের জ্বালা জুড়োনোর একটাই উপায় । মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে ভীম যদি এই ব্রতের পালন করে তবে তোমার জ্বালা জুড়োবে । তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত দেহতাত কমে যাবে ।
এই কথা শোনামাত্র শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে বরুণদেব  দৌড়ে গেলেন ভীমের কাছে । বনের মধ্যে দেখা হল ভীমের সাথে । একাদশীর ব্রতের কথা ভীম  অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন । অগ্নিদগ্ধ বরুণদেবের গাত্রজ্বালা উপশম হল । 
মহাভারতের ভীম নাকি দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন । 
 পঞ্চপান্ডব এই গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বনবাসে চলেছিলেন । সে কথার উল্লেখ কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতে পাওয়া যায় ।  কুন্তী পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন সেই জঙ্গলেই । আর সেখানেই উপজাতি পরিবারের রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন হিড়িম্বা এসে উপস্থিত হল ।  মহা উল্লাসে নরখাদক হিড়িম্ব তার কাজ সারতে পঞ্চপান্ডব সহ মাতা কুন্তীকে সংহার করতে উদ্যত হল আর মহাবলী ভীমসেন তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ।   হিড়িম্বকে বধ করে ভীমসেন তার দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর সাথে তার পর ভীমের প্রণয় ও গান্ধর্ব মতে তাকে বিয়ে ( এবং অবশ্যই সেই সময় বিয়ে না করে উপায়ও ছিলনা ভীমের, কারণ অরণ্যে শয্যা পেতে উপজাতিদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহবাস না করে কি উপায় থাকে! ) স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকালে "মেদ" উপজাতির বাসভূমি হিসেবে মেদিনীপুর ভূখন্ডর নাম  এই ঘটনার সাক্ষী বহন করছে খড়গেশ্বর ও তার অনতিদূরেই হিড়িম্বেশ্বরী কালীর মন্দির যা পুজো করতেন মহাভারতের ভীমের পত্নী হিড়িম্বা । অতএব উপজাতির আবাসস্থল হিসেবে এই তথ্যটিও ফেলে দেবার নয় ।   

হিড়িম্বার সাথে এইখানেই  তার আলাপ । তাই ভীমের পুজো করার জন্যই ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ভীম-একাদশীর ব্রত পালন করেন ।  
এই প্রচলিত গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন দেখি ভীমের মাতৃভক্তি ঠিক তেমনি দেবলোকেও দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিপত্তি বা এখনকার "দাদাগিরি" ও বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের  ।   
  বাংলার লোকসংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ভীমপুজোয় এই বিপুল আয়োজন আর আড়ম্বর দেখে মনে মনে বাঙালী বলে গর্বিত বোধ হয় । দশাস‌ই ভীমসেনের এই মূর্তি যেন মেলার একাই একশো। মাথাভর্তি কুঞ্চিত কেশ, শ্বশ্রূগুম্ফ সম্বলিত পৌরুষ যেন চিরন্তন বীরত্বের প্রতীক । কোথাও ইনি ভীমসেন, কোথাও বা খেত্তী ভীম, হালুয়া ভীম আবার কোথাও হুলা ভীম কিম্বা চাষী ভীম । কিন্তু সেই মহাভারতের মধ্যমপান্ডব স্থান-কাল-পাত্রভেদে যুবশক্তির বহিঃপ্রকাশ।  আর সর্বোপরি ভীমের এই পুজো যেন সমগ্র দক্ষিণবাংলার কৃষিপুজো কারণ তিনি তো আদতে পবনপুত্র ।  বায়ু আর বৃষ্টির হাত ধরে উর্বর হবে বাংলার মাটি। সবুজে সবুজ হয়ে উঠবে আবাদীজমি এই আশায় গাঁয়ের মানুষের এই বিশ্বাসে নতজানু হয়ে ভীমকে প্রণাম জানাই মনে মনে ।  
  এখন প্রশ্ন হল দক্ষিণবঙ্গে কেন ভীমপুজোর এত জনপ্রিয়তা? কৃষি ছাড়াও এখানকার বন্দর নরী তমলুকে একসময় বহু জাহাজ সমাগম হত। চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙার মত অনেক ব্যবসায়ীর পণ্যবোঝাই জাহাজ এসে ভিড়ত হলদিয়া বন্দরে । আবার রফতানি হত ভারতীয় সামগ্রী যবদ্বীপ, সুমাত্রা, বালির দিকে । বাতাসের আনুকুল্যে নিরাপদে,  নির্বিঘ্নে যাতে জাহাজ যাত্রা বা আগমন সফল হয় তাই পবনপুত্র ভীম সহায় । জাহাজ যাত্রা যাতে অগস্ত্যযাত্রার মত শেষযাত্রা না হয় তাই জলদস্যুর আক্রমণের স্বীকার না হওয়ার উদ্দেশ্যে ভীমের পুজো করে পাঠানো হত জাহাজগুলিকে । তাই সেই কারণে দক্ষিণবঙ্গের এই পবনপুত্রের ওপর ব্যবসায়ীদের ছিল প্রগাঢ় আস্থা ।  

২টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

darun laglo re......ei galpo ta jantam na.........besh likhechhis kintu.....

Neena.

Unknown বলেছেন...

khubi upokrito holam