২৭ মার্চ, ২০১৩

দোলের ব্র্যান্ড ডাইলুশান !








মাদের দোল ছিল কিছুটা অন্যরকম । শহুরে দোল যেমন হয় । আগের দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম ন্যাড়াপোড়ার আয়োজন । ফাঁকা মাঠ থাকলেই শুকনো গাছপালা কেটে "যাক্‌ পুরাতন স্মৃতি, যাক্‌ ভুলে যাওয়া গীতি"  নতুন বর্ষবরণের আগে ধুয়েমুছে পুরোণো জঞ্জাল সাফ !
সূর্য্যিডোবার আগেই রেডি পাড়ার কচিকাঁচারা । তারপর ঝুপ করে সন্ধ্যে নামলেই আমরা বারান্দায় লাইন করে । কোন্‌ পাড়ার ন্যাড়াপোড়ার আগুণের লেলিহান শিখা কতদূর গিয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই ! বিখ্যাত সেই প্রাক্‌ দোলযাত্রার ট্যাগলাইন...
 "আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠবে বল হরিবোল! এ যেন ন্যাড়াপোড়ার রিয়েলিটি শো ! এখন অবিশ্যি না হওয়াই ভালো । নেই খালি মাঠঘাট, পলিথিনিক পথঘাট । পর্যাপ্ত প্লাসটিক পূর্ণ পরিবেশে ন্যাড়াপোড়া নৈব নৈব চ!
অতএব কচিকাঁচা-সবুজ অবুঝ সকলেই মজিনু নীল সেই একফুটের স্ক্রিণে, ভুলিনু ন্যাড়াপোড়া, খেলিনু ক্রুদ্ধ পক্ষী অথবা আপডেটিনু মুখব‌ই দেওয়াল ।
পরদিন সত্যনারায়ণের পায়ে ঢিপ করে পেন্নাম করে আবীর দিয়ে পিচকিরী, বালতি ভরে রঙের গোলা আর বারান্দা দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে রং ভর্তি বেলুন মারা ! আর কারোকে না পাও তো সাদা ধোপ দুরস্ত ফতুয়া পরা বাজার অভিমুখী বাবা, দাদাকেই দাও রং কিম্বা বেচারা কাজের মাসীকে একেবারে চুবিয়ে দাও রঙে । আর সাথে অবিরত মুখ চালানো । ঠাকুর ঘর থেকে ঠাম্মার পুজো করা ফুট কড়াই মুড়কির চূড়ো ক্রমশঃ নিম্নগামী হতে থাকে । হাতে রঙীন মঠ । তখন কেউ ফতোয়া জারিও করেনি মঠের রঙের ওপর । লাল মঠে এলিজারিন, হলুদে মেটানিল..এটা খেওনা, সেটা কোরোনা !

ক্রমে যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজগেট, তখন দোল বেশ সিরিয়াস অনার্সের চাপে । তবে দোল ছিল প্রকৃত দোলের মতন । অন্যরকমের মাদকতা আর একটা বিশেষ ছুটির দিনে দোলকে দোলের মত করে পাওয়া ।
তখন না ছিল ইন্টারনেট না মোবাইল ফোন অথবা হাজারো কেবল চ্যানেল । অগত্যা দূরদর্শনের দোলের বৈঠকি ! তবে মায়ের হাতে স্পেশ্যাল রান্না ছিল সেদিনের মুখ্য আকর্ষণ । সকালে পোলাও-মাংস কিম্বা রাতে লুচি আলুরদম ছিল দোলের স্পেশ্যালিটি কুইজিন ।
কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির একলাফে ট্রানজিশান যেন গ্রাউন্ড লেভেল থেকে এক্সাইটেড স্টেটে ফার্স্ট ঝাঁপিয়ে পড়া । কো-এড বাতাবরণ । রঙীন চশমা চোখে আর সদ্য ফুটিফুটি যৌবনে পা রাখার আনন্দ । হেদোর মোড়ে ফুচকা তদ্দিনে পার্শিবাগানে পাড়ি দিয়েছে । বিধানসরণীর চাচার রোল তখন রাজাবাজারে ঊত্তীর্ণ । সেবার প্রচুর ফাগ খেলা হল একপাল ছেলে মেয়েতে মিলে । সেই প্রথম ছেলে বন্ধুদের সাথে দোল খেলে লালটুকটুকে হয়ে লজ্জায় সবুজ হয়ে মিনিবাসে বাড়ি ফেরা । তবুও আনন্দ আকাশে বাতাসে । কারণ মম যৌবন নিকুঞ্জে তখন পাখিডাকার শুরু হয়ে গেছে । মা বরং খুশিই হলেন । এই তো জগতের নিয়ম । প্রকৃতির গাছে পাতা ঝরে নতুন পাতা আসবে । আমগাছে মুকুল আসবে । বাদাম গাছের পাতা ঝরে গিয়ে লাল ফুল সর্বস্ব গাছ হবে এই তো বসন্তের নিয়ম ! মায়ের একরত্তি মেয়েটা কেমন বড়ো হয়ে গেল!
তখন বসন্তে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পাসপোর্ট যেন পাওয়া হয়েই যেত সরস্বতী পুজোতে । তারপরেই দোল । অতএব সেই পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসা পেয়ে গেছি । তাই সব কিছুতেই মায়ের সায় ।
লালগোলাপ দিয়ে ভালোবাসার কোর্টশিপ চালু হতে না হতেই বিরহিনী যক্ষের মত দোল রঙীন হত নীল খামে পারফিউম মাখানো চিঠির ভাঁজে লিপষ্টিকের চুমু পাঠিয়ে সাগরপারে ।
কারণ  তখনো হিমেল বসন্তে ইমেল নেই । দোলের দিনে নীলখামে আর্চিস গ্যালারির একটুকরো চিরকূটের নীরব প্রতীক্ষা । বুক ফেটে যায় তো মুখ ফোটেনা । উদাসিনী বেশে বিরহিনী আমি দোলে পেলাম অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার সেই নীল খাম । তারপর একে একে গায়েহলুদ, সপ্তপদী ও দোলের গালের লাল রং উঠল সিঁথিতে ।

এখন ফাগুনের ফুল ঝরতে না ঝরতেই চকোলেট-ডে, প্রোপোজ ডে, হাগ-ডে, কিসিং-ডে, ভ্যালেন্টাইনস-ডে পেরিয়ে দোল দে । দোলের আবীরগুঁড়ো অহোরাত্র উড়তেই থাকে ফেসবুক জানলায়, দেওয়ালে, বারান্দায় । দোলের রঙের গড়িয়ে পড়তে লাগল অর্কুট অলিন্দ দিয়ে । সেই রঙ গিয়ে পড়ল ফেসবুক উঠোনে ।

এখন দোলের রঙের ওপরেও টেকশো ! রূপ সচেতন বঙ্গতনয়ারা স্কিনফ্রেন্ডলি রং চায় ! ইকোফ্রেন্ডলি আবীর, ভেষজ গুলালে ফ্যাশন ইন ! তাই ডিজিটাল দোল খেলো বাবা!  নো হ্যাপা !  আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না, রং খেলবোনা ! 

ভাগ্যি সোশ্যালনেটওয়ার্ক ছিল প্রেমের সাথে ! দোলখেলার বৃত্তটা কিন্তু ছড়িয়েছে আগের থেকে । দোলখেলার প্রেম বেঁচে বরতে থাকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত । এখন দোলখেলার বাতাস সোশ্যালনেটওয়ার্ক ময়তায় । ফেসবুক উজাড় করে ঘন্টার পর ঘন্টা দোলখেলা পেরয় ডিঙিনৌকো করে । ডিজিটাল ঢেউ পেরিয়ে ট্যুইটারের চিলেকোঠাতেও মুখ লুকোয় সেই দোলখেলা । দোলের রং ঝরছে সর্বত্র । ফাগ উড়ছে অনাবিল আনন্দে ।

সারারাত ধরে অনলাইন চ্যাট করে রাতে আধোঘুমে স্বপ্নসুন্দরীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কোথা দিয়ে বসন্তের দোলখেলার সকাল এসে পড়ে ! আর এই মোবাইলফোন ? সেও তো দোলের একটা দারুন পজিটিভ ক্যাটালিস্ট । কত সহজে একটা কথা মেসেজ করে জানিয়ে শুরু হয়ে যায় দোলের । মনের মানুষটির হাতের মুঠোয় দোলের ভালোবাসার দুটো কথা টুক করে চলে যায় । আঙুলে আঙুলে এমন চটপট প্রেম কিন্তু আগে ছিল না । এখন অনেক সহজ হয়েছে দুনিয়া ।বাজারে গ্রিটিংস কার্ডের হার্ডকপি ফুরোল, ভালোবাসার নটেগাছ লকলক করে ডালপালা বিস্তার করে দিল ওয়েব দুনিয়ায় ।
দোলের উপহারের তালিকায়  আইপড কিম্বা পেনড্রাইভের কাটতি বেশী । দোলের কবিতার খাতা লুকিয়ে থাকত বালিশের নীচে । আর এখন সেই কবিতা ঝরে ঝরে পড়ছে ফেসবুকের বারান্দায়, কার্ণিশে সর্বত্র । তবে দোল আছে দোলেতেই । একটু অন্য আঙ্গিকে ।  
তখন ছিল তরতাজা সত্যি গোলাপ । আর এখন তা ডিজিটাল । ছিল বসন্ত কেবিনে দুজনে মুখোমুখি দুটো ডিমের ডেভিল কিম্বা ফাউল কাটলেট । এখনো সেই সংজ্ঞা বদলায়নি কিন্তু চপ-কাটলেট থেকে প্রেম এখন বার্গার-মকটেলে আছড়ে পড়েছে অবিরত । দোলের দিনেও সেই হ্যাঙ আউট । শুধু বসন্ত কেবিন এখন বাসন্তী নীল ফেসবুকের কফিহাউস কিম্বা ডিজিটাল ঠান্ডাই শরবতি মেসেজ আদানপ্রদানে, আমাদের সাথে রঙবাজি করতে । আমরা দোলবাজি করি অন্যভাবে । কিছুটা ফেসবুকি দলবাজিতে অথবা ব্লগবাজির ঠেকে । দোলের সেই আনন্দ আর পাইনা খুঁজে । ফুটকড়াই মুড়কি মঠ হারিয়ে গেল । দোলের আটপৌরে আভিজাত্য হারিয়ে গেল ।স্মার্ট হোল দোলবাজি । দোলা লাগল ফেসবুক-বনে কিন্তু দোলের রং লাগল না মনে । দোলের ব্র্যান্ড ডাইলুশান হল !

মক্‌টেল থেকে চকোলেট, কফি থেকে কেক, সোনা থেকে জাঙ্ক সর্বত্র হিয়ার মাঝে লুকোনো হ্যাপি হোলি! হোলির ধামাক, হোলি বাম্পার, হোলি হ্যায় !
শপিং মলে, মেট্রোরেলে, সুইমিংপুলে, তন্ত্রেমন্ত্রে হোলি হ্যায়
 
সেই কবে কবি বলেছিলেন ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত ! তারা পলাশ চিনুক না চিনুক আজ কিন্তু ভালোবাসার দোলের দিন আগতপ্রায় । দোলের রঙ লাগতে না লাগতেই ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করতে হবে... মন্দারমণির বালুকাবেলায় লিখিনু সে লিপিখানি প্রিয়তমারে । ঐ কূলে আমি আর এই কূলে তুমি মাঝখানে একরাশ ডিজিটাল ঢেউ বয়ে যায়

১২ মার্চ, ২০১৩

স্মৃতিরূপেণ

বলো তো! আমারা আবার স্মৃতি! কয়জনা যে পড়বে তা অজানা ।  তবুও লিখতে চাই ! ভাবতেও চাই পুরোণো কথাগুলো। ভাগ্যি সাথে ছিল আদরের নৌকা । আপাতত সেখানেই ভেসে চলুক আমার স্মৃতিকণারা ।   যদি তোমাদের ঘুম ভাঙে তোমরাও ভাসতে পারো স্মৃতির ভেলায় আমার সাথে অথবা নিজের সাথে ।   শুরু হল আমার কথা আদরের ব্লগে ।