গ্রামের নাম হাজার ঘড়ি কুমোরপাড়া । দক্ষিণবাংলার নদীমাতৃক অঞ্চল। আরো কিছুটা এগুলেই সমুদ্রের নোনা জল আর বালিয়াড়ি দেখা যাবে । গ্রামবাংলা অনেকটাই শহুরে হয়েছে নগরায়নের দৌলতে। অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে । কিন্তু গ্রামবাংলার মানুষের সেই দারিদ্র, সেই অতিবৃষ্টির জন্য বানভাসি ঘর দুয়ার অথবা খরায় বৃষ্টির হাহাকারে ধান লাগাতে না পারার কষ্ট রয়েই গেল । যারা পরল তার মধ্যে থেকেই পালিয়ে গেল চেন্নাই অথবা হায়দ্রাবাদে কিম্বা ব্যাঙ্গালোরে , যা হোক একটা চাকরী নিয়ে আর যারা নিতান্তই সাদাসিধে, অল্পে সন্তুষ্ট তারা পড়েই থাকল বদ্বীপের ফাঁকে অধঃক্ষিপ্ত নাগরিক হয়ে । পঞ্চায়েত আপিসে হানা দিল। পার্টি আপিসে দৌড়ালো অথবা ভোটও দিল কথামত ঠিক সময়ে, সঠিক চিহ্নে । তবুও তাদের উত্তরণ হলনা । কাকভোরে আমরা বেরিয়েছিলাম হাজারঘড়ি গ্রামের উদ্দেশ্যে । রায়দীঘি পৌঁছলাম ঘন্টা চারেক পর । তারপর সেখান থেকে একাদশ শতাব্দীতে তৈরী অতি প্রাচীন একটি মন্দির দেখতে যাওয়া হল ।
জটার দেউল মন্দিরের নাম । স্বয়ংভূ শিব মন্দির । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দেখভালে মন্দির ও তার আশপাশ বেশ সংরক্ষিত তবে তৃতীয় বিশ্বের চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকরা যথারীতি পর্যাপ্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক পূর্ণ করে ফেলেছে ঐ সুন্দর এবং নিরিবিলি স্থানটিকে । ঐ একটি কাজে আমরা খুব পটু। তা হল নিয়ম ভাঙা । সেখানে গার্বেজ ফেলার ব্যাবস্থা করে রেখেছে এ এস আই তবুও সংবরণ করা যায়না যত্রতত্র জঞ্জাল ফেলার অভ্যাসকে । মন্দিরের গায়ে পোড়া ইঁটের ওপর নিখুঁত স্থাপত্য । অনেকটাই সময়ের ভারে নষ্ট হয়ে গেছে । অভ্যন্তরে গর্ভগৃহের মধ্যে তাকালে দেখা যায় কত উঁচুতে দেওয়ালের গায়ে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর ব্যাবস্থা ।
ঐ গ্রামের বৌটি আমাদের জন্য লুচি আর আলুর দম বানিয়ে হাজির হয়েছিল রায়দীঘিতে । তারপর গরম চা । সেখান থেকে আমরা গেলাম সেই গ্রামের আতিথেয়তার স্বীকার হতে । পূর্ব পরিকল্পিত চড়ুইভাতি বা প্রকৃত অর্থে বনভোজনের মেজাজ নিয়ে । ধানজমির সরু আলের মধ্যে দিয়ে ডাইনে পান্নাপুকুরের সবুজ জলে ভাসমান গোলাপী শালুক আর বাঁয়ে গোলা ভরা ধান চলল সাথে । কোথাও হলুদ সর্ষে ক্ষেত কোথাও আলু, একফালি সবুজ কচি ধানগাছের পিছনে সয়াবিনের ক্ষেত অথবা ফুলকপি ।
বড় সুন্দর এই অনুভূতি। শহর থেকে গিয়ে শুধু সবুজে চোখ জুড়োনো যে কি ভালো লাগে! বারবার এই মাটির রূপ দেখতে ইচ্ছে করে । দীঘিভরা জল করে টলমল।শীতকালে খেজুরগাছে হাঁড়িবাঁধার ধুম । আর স্নানের অছিলায় গ্রাম্য বধূর পুকুর সাঁতরে গামছা দিয়ে চিংড়ি-কাঁকড়া নিয়ে ভিজে কাপড়ে ঘরে ফেরা ।
এখনকার
প্রজন্মের কাছে শীত-পিকনিক মানেই কেটারিংয়ে কব্জি ডোবানো, দুটো সাউন্ডবক্স
থেকে জোরদার গানের সাথে উদ্দাম নৃত্য আর ইবিজা, কান্ট্রিক্লাব বা বেদিক
ভিলেজের মত বিলাসবহুল আপ্যায়নে অবগাহন। এর থেকে অব্যাহতি পেতে গতকাল আমরা
বনভোজনে গেলাম দক্ষিণবঙ্গের রায়দিঘীর
কাছেই এক গ্রামে ।পালবংশের আমলে তৈরী অতি প্রাচীন মন্দির "জটার দেউল"
দেখা একটি বিশেষ পাওয়া ।
খাড়ির জল যত্রতত্র খেলে বেড়ায় সেগ্রামে । মাটীর নীচে কাঁকড়ার
বাসা যেখানে আর ধানক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে দিয়ে হেঁটে আসা যায় সেখানে ।
কুড়োনো যায় নোনাবালির মধ্যে থেকে ঝিনুক আর শামুকের খোলা । সুন্দরী আর গরাণ
গাছও আছে কিছু । কচি কচি টোপা কুল ধরেছে গাছে । কচি নারকেল পাড়িয়ে তেষ্টা
মেটানো।খেজুর গাছে হাঁড়ি এখনো বাঁধেনি
তারা । ঠান্ডা নেই । কুয়াশা নেই তাই । বড় বড় কাঁকড়া ধরানো হল গর্তর মধ্যে
থেকে । দাম পেয়ে গ্রামের মানুষ ও বেজায় খুশী । আমাদের ভ্রমণের সাথে সাথে
গরম ভাত মাটির উনুনে ফুটতে লাগল । আমরা পৌঁছতেই মাটির ঘরের দালানে রেডি
দুপুরের আহার ।গরম ভাত, ডালের সাথে নদী থেকে সদ্য ধরা চুনোমাছ ভাজা , ক্ষেতের টাটকা
শাকসব্জীর চচ্চড়ি, দিশী মুরগীর ঝোল আর টমেটোর চাটনী ।
তেলা মাথায় তেল না দিয়ে তোমরাও ভেবে দেখতে পারো গ্রামের
মানুষদের সাথে কি করে কিছুক্ষণ কাটিয়ে মাটির গন্ধ নিয়ে আসা যায় । প্রকৃত
অর্থে চড়ুইভাতি হল কাল । মাটির উনুনে রান্নাবান্না আর টিউকলের জলে আঁচানো
সব মিলিয়ে আমি ও আমার সর্বক্ষণের ওঠাবসার সাথীরা বেজায় খুশি । আর অতিথি
আপ্যায়নে গ্রামের মানুষের কোনো খামতি নেই । ফেরার পথে তাদেরি বাড়ির একজন
প্রত্যেকের হাতে একঠোঙা করে মুড়ি, আলুর চপ আর বেগুনী দিয়ে দিল গরম গরম ।
ওরাও খুশি একটু বিক্রিবাটরাও আর আমরাও খুশী প্রাকৃতিক বনভোজন সেরে ।
Truly your's হয়েই থাকলাম পশ্চিমবাংলা।
তোমার সবুজে সবুজ আর নীলিমায় নীল
দিগন্তে আমি মোহিত আবারো । আক্ষেপ কেবল একটাই.. শুধু চাই ভালো ও চওড়া রাস্তা যাতে শহর থেকে গ্রামের মানুষগুলো সহজেই আসা-যাওয়া করতে পারে আর চাই একটু শিল্প । গ্রামবাংলার যা আছে তা অনেকের কাছে ঈর্ষার । শুধু চাই দক্ষ পরিচালনা আর পরিকাঠামো । চাষের জমি থাকুক । পাশাপাশি ফ্যাক্টরি হোক দু-চারটে । ঐ
মানুষগুলোর কর্মসংস্থান হোক ! শুধু চাষ করে আর মাছ ধরে ওদের দুবেলা পেটটা হয়ত
ভরে কিন্তু কুঁজোরও তো চিত হয়ে শুতে ইচ্ছে হয় !
৪টি মন্তব্য:
বাহ! দারুণ বনভোজন! অনেক দিন পরে আপনার ব্লগেও বেড়িয়ে গেলাম!
thanks Sushanta!
অনেকদিন পর সোনার তরী পড়লাম। খুব ভালো লাগল - এক্কেবারে খাঁটি কথা লিখেছেন, আমাদের যা আছে তা ভোলার নয়। শুধু মানুষগুলো একটু ভালো থাকুক - ওদের নিয়ে অযথা রাজনীতি একটু কম হোক, একটু শিক্ষার আলো পৌঁছক।
khub vaalo laaglo
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন