জয় গোস্বামীর নতুন বই "জলঝারি" পড়লাম। প্রথমবার জলঝারির ক'ফোঁটা জল আমার গায়ে পড়তে না পড়তে ই বাস্প হয়ে মিশে গেল হাওয়ায়। পরের বারে ঠান্ডা জলে সিক্ত হয়ে আমার একটু কাঁপুনি এল! শেষ বারের সবজলটুকু চেঁচে পুঁছে নিয়ে আমি মেখে নিয়েছি আমার মনের গায়ে । জলঝারির জল পড়ে ঝরাপাতা আজ নড়ে উঠেছে! হোক না সে বাগানের ঝোপের কোণে
পড়ে থাকা ফেলে দেওয়া এক জলঝারি, থাকনা তার মরচে পড়া বিবর্ণতা ! আমাদের মতো ঝরাপাতাদের দলে যারা তাদের জন্য এই জলঝারির পড়ে থাকা জলটুকু অনেক । কবি মুখবন্ধে নিজেই বলেছেন, যেসব সম্পর্ক নারী-পুরুষ কে প্রকাশ্যে আনতে পারেনা অথবা প্রকাশ্যে এলেই ঝড়-তুফানে তা ধ্বংসেই বিলীন হয়ে যায় সেই সব সম্পর্ক নিয়েই কিছুটা গদ্যে এবং কিছুটা পদ্যে লেখা এই "জলঝারি" বইটিতে জলঝারি কবিতাটি অনবদ্য! আমাদের মত যারা জীবনকে খানিকটা এযাবত্কাল দেখে এসেছে, বিশ্বাসের ভেলায় চড়ে ভেসে ভেসে খানিকটা উপলব্ধি করে এসেছে, সম্পর্কের টানাপোড়েনে যারা জীবনের জলছবি আঁকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে তাদের জন্য এই জলঝারি ।
প্রথম গল্প "ভুলভুলাইয়া" নি:সন্দেহে শিউলির নস্টালজিয়াকে মনে করিয়ে দেয় নতুন করে, কিন্তু তার চেয়ে ও সুন্দর লেখকের শব্দ নিয়ে ভেলকি দেখানো, যেখানে তাঁর একদিকে প্রকৃতি প্রেম অন্যদিকে প্রেমের জোয়ারে ভাসমান অবস্থায় কিশোরীটির একদিকে ঝগড়া করতে পারা অন্যদিকে "শিউলি পারা", "উঠোন পারা", "ভোর পারা" এই ভাবে ভালোলাগা গুলিকে বর্ণনা করা খুব নতুন ধরনের । তারপরে যখন মেয়েটি আরো বড় হয়েছে সেই প্রেম তার ততদিনে উধাও। তাই সে বলে "আজ আমার ভোরও ঘটেনা, শিউলিও ঘটেনা, উঠোনও ঘটেনা" অর্থাত কিশোর প্রেমে এই গুলি ঘটতো | সে ও তখন প্রেম কে আঁকড়ে ধরে ভোর, শিউলি এবং উঠোন কে চাইতো ; এখন প্রেম না থাকায় তার জীবন ননরোম্যান্টিক জীবনে পর্যবাসিত হয়েছে ।
"আমাদের পাখিগুলি হবে" তে রাগ-রাগিনীর মধ্য দিয়ে যাত্রাপথের বর্ণনা নতুন ধরনের । যেমন "ভীমপলশ্রীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, পৌঁছবো পুরিয়া ধ্যানেশ্রীতে " এর থেকে আমরা পাই সঙ্গীতানুরাগী জয় গোস্বামীকে।
"চিহ্ননাম" শুরু একটি মনছুঁয়ে যাওয়া কবিতা দিয়ে শেষ কিছুটা গদ্যে । আবার আবিষ্কার করি কবিকে...মনে মনে বলি, "তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে" চিহ্ননামের ঘুড়ির সুতো ধরে পৌঁছে যাই গল্পগদ্যে। ব্যর্থপ্রেমের ভার বয়ে চলেছে কেউ একজন ; তার প্রেমিকা আজ বিবাহিতা। আর স্মৃতির ক্যানভাসের একটি করে পাতা ওলটায় সেই ব্যক্তিটি । রোমন্থন করে প্রেমিকার সাথে তার প্রথম প্রেমের সুখস্মৃতি । শালীনতা, রক্ষণশীলতার লক্ষণরেখা কে মুছে দিয়ে কেন তাদের প্রেম প্রকাশ্যে আসবে না সেই নিয়ে বিষাদসিন্ধুতে ভাসিয়ে দিলেন প্রেমিকাকে লেখা কবিতা ।
"কড়ি ও কোমল" গল্পে আমরা শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙা পেরিয়ে শান্তিনিকেতনের চেনা পথঘাট দিয়ে সাইকেলে দুই যুবক-যুবতীর আলাপচারিতা বেশ লাগে। রুদ্রপলাশ, পূর্বপল্লীর গেষ্টহাউস, রাঙামাটি হোটেল, গোয়ালপাড়ার পথ ধরে খোয়াই নদীর ধারে এসে খোয়াই কে নিজের করে চাওয়া ঠিক যেন আমার চাওয়ার মত । তবে মেয়েটির খোঁপাতে ধনেপাতা গোঁজাটা একটু অন্যকিছু হলে ভালো হ'ত। কারণ শক্তডাঁটি না হলে পাতা গুঁজবে কি করে? প্রান্তিকের ক্যানালের ধারে, তাদের প্রেমালাপ, অজয়নদরূপী উদাস বাউলের সাথে মেয়েটির ফ্যান্টাসি ভালো। তবে শুদ্ধ-কোমল স্বরের ব্যঞ্জনা খানিকটা একঘেয়েমি এনে দেয়। শান্তিনির সব নৈসর্গিক সম্পত্তি এমন কি গোয়াল পাড়ার ঢোলকলমি থেকে শুরু করে সোনাঝুরির সব পাতা তিনি দিতে চেয়েছেন প্রেমিকাটিকে উজাড় করে সেখানে মেয়েটির শুদ্ধাশুদ্ধ না আনলেও চলত। ভালোবাসা যদি নিখাদ হয় সেখানে শুদ্ধতা যাচাইয়ের তো প্রয়োজন নেই। অবশ্য এখানে তাঁর পোয়েটিক লাইসেন্সকে আমি অস্বীকার করি না ।
"কাঁটাতার" পড়ে মনে হ'ল এক অপূর্ব বাস্তবতার চিত্র এঁকেছেন কবি, লেখক শিল্পী জয় গোস্বামী । সব সম্পর্কের মধ্যে তিনফুট ছাড় রাখাটা যে কতটা জরুরী সেটা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি আমি। দুটি মানুষের মধ্যে যেকোনো সম্পর্কের ইতি ঘটে কাঁটাতারের বেড়া লঙ্ঘনের জন্য..এই জীবন দর্শন অনবদ্য। সীমান্ত লঙ্ঘনের পরিণতি সম্পর্কে আমরা সকলেই সচেতন এবং অবৈধ সংসর্গের ক্ষেত্রে তার পরিসমপ্তি ঘটে আত্মহনন, বিচ্ছেদ ইত্যাদিতে । কৌতুহলের এবং জ্ঞান-উপদেশের তীর বিদ্ধ হয়ে, সমাজবৃত্তে থেকে একঘরে হয়ে হীনমন্যতার স্বীকার হতে হয়। তাঁর মতে এই সব পরকীয়া প্রেম কাঁটাতারের বেড়া লঙ্ঘন না করে "নো ম্যানস ল্যান্ডে" থেকে ও চলতে পারে ; দুদেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী জায়গায় দুদন্ড দাঁড়িয়ে মনের কথা বলে আবার যদি ধীরে ধীরে ফিরে যাওয়া যায় অর্থাত দুপক্ষের কেউ জানালো না কথাটা, কেবল সেই সম্পর্কের টানাপোড়েনে জর্জরিত মানুষদুটি ছাড়া। তাহলেও কিন্তু আমার মনে হয় "এই কুলে আমি আর ঐ কুলে তুমি"র মত মাঝখানে বিশ্বাসের সূতোটা আলগা হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, একথা স্বীকার না করে পারা যায় না, নিখুঁত লেখনীর বুনোটে "নো ম্যানস ল্যান্ডে" ডিঙি নৌকায় বসে কথা বলে চলে আসাটা নি:সন্দেহে উপভোগ্য।
"বিরহ" গদ্যে আমরা আবার নতুন করে আবিষ্কার করি প্রেমের বিরহ যন্ত্রণাকে, যা নাড়িয়ে দেয় পাঠকমন কে। সংসার কটাহ তলে জ্বলতে জ্বলতে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়া প্রেমের মধ্যে থেকে নিভে যাওয়া বিরহের অবসর.. এ ধারণাও অসাধারণ ।।
জলঝারির অনবদ্য রঙীন প্রচ্ছদ অলংকরণের পুরো কৃতিত্বটুকু প্রাপ্য কৃষ্ণেন্দু চাকীর । বইটি সত্যি সত্যি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। জয় গোস্বামী আরও লিখুন আর আমাদের পাঠকমনকে নাড়িয়ে দিন এই কামনা করি । কিন্তু তিনি তো আজীবন শিল্পী, অবিসংবাদী কবি তাই তাঁর শেষ গদ্যের এই স্বীকরোক্তি "মধ্যবয়সের বিদ্বেষ চর্চার জ্বালা, প্রতিহিংসা বহন ও তার দাহ এসবের চেয়ে প্রেমের অভিশাপ বরং শ্রেয় " এই কথাটি মনে রাখার মত
৬টি মন্তব্য:
"Joljhari"r review theke jhore pora joler fnoTaGulo pathokke druto Tene niye jay mUl boiTir dike. khub antorik alochona.
onek shubhechchha...
ভালো লিখেছেন! বইটা নিশ্চয়ই পড়তে মন চাইছে। কিন্তু দিদি, আমি যে দেহে থাকি, সে দেশে বাংলা বই বাঙালিরা পড়ে না! সুতরাং ব্জারে মেলে না। তবুও আমি গুয়াহাটি গেলে নিশ্চয়ই খবর করে এনে পড়ব। আপনি কি এই আলোচনা কোথাও ছাপবেন বলে ভেবেছেন? আমার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লেখাটা দৈনিক জনকণ্ঠে বেরুচ্ছে। সেই কাগজের লিঙ্ক সহ লেখাটা আপাম ব্লগের শুরুতেই আছে। দেখবেন!
আমি আপনার ব্লগ আপডেট আমার অরকুট ও ফেসবুকে দিচ্ছি।
anek dhonyobaad khabor ta ekhane deoar jonye;asole sevabe niyomito to pora hoyna...valobasar taane jatotuku pari pori.taai apnar blog e ese satyii khoob anondo paai.hoyto sabsamoy comment dite parina.anyway valo thakben.
porar shujog hoyni ekhono
tabe jagiye dile utshaho,
joy sadai ektu anya dhatu
bhashiye daye hatat bahudoor.
Ami je amar chinta tomader sathe share korte perechhi etai bhalo laglo! tomra boita poro plz...ei boyoser anek upalobdhi bhalo lagbe...
Durbhagyaboshoto Jaljhari boita collect korte pari ni ekhono. Joy Goswami amar priyo kabider modhy ekjon...onar godyo o jeno kabitar chhande lekha...Indira tomar lekha pore boita porar ichha aro bere galo...Indira--tumi aro lekho....
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন