৫১বর্তী বইটির রিভিউ লিখলেন
হায়দ্রাবাদের বাসিন্দা, সক্রিয় নাট্য ব্যাক্তিত্ব, একটি LPO তে কর্মরত সৃষ্টিশীল মানুষ শ্রীমতী রীতা ঘোষ।
৫১ বর্তী : বাঙালির হারানো ৫১ পদ
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এর এই বইটি কয়েকদিন ধরে পড়তে পড়তে আমার মন যেন কোথায় ভেসে যেত, তাই তো অনেক বেশি সময় নিয়ে পড়লাম। মন চলে যেত সেই ছোটবেলার দিনগুলিতে, যখন, অনেক রান্নাঘরেই কয়লার উনুন ছিল। সেই রান্নার স্বাদই ছিল আলাদা, সাধারণ মাছের ঝোল বা ডিমের ডালনা হয়ে উঠতো অতুলনীয়। আমার অনেক আত্মীয়র বাড়িতে, ঝকঝকে সোনার মতো কাঁসার থালাতে খেতাম। আহা, সেই সব দিন যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। আবার কখনো, দিদার বাড়িতে, খেতাম ,আমার জন্য রাখা স্টিল এর থালায়, দিদার হাতে গোবিন্দভোগ চালের ভাত, ঘি বা মাখন দিয়ে মাখা, সঙ্গে আলুসেদ্ধ। দিদা, থালায়, ভাতের গোল্লা করে রাখতেন, আমায় গল্প বলে খাওয়াতেন, আর সেই গোল্লাগুলি ছিল, কাকের ডিম্, বকের ডিম্, হাঁসের ডিম্ ইত্যাদি। অতি সাধারণ খাবার হয়ে উঠতো অসামান্য। আমার মায়ের ও শাশুড়ি মায়ের হাতের রান্নার কথা মনে পড়ে গেল। আমার বাপের বাড়ি, মামার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি, সবই ওপার বাংলার, তাই রান্নাতে ওপার ও এপার বাংলার প্রভাব। আমার শাশুড়ির হাতের শুঁটকি মাছের ঝাল বা চিতল মাছের মুইঠ্যা আমার প্রিয় খাবারের মধ্যে পড়ে। সেই সঙ্গে, বিউলির ডাল, আলু পোস্ত, ভেটকি মাছের কাঁটা চচড়ি, চিংড়ি মাছ- সবই আমার অতি লোভনীয় খাদ্য।
বইটি হাতে পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম, এটি একটি রান্নার বই। কিন্তু না, কি অপূর্ব, কনসেপ্ট, সুন্দর স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে রান্নাঘরের হেঁশেল কথা। ভাষার গাঁথুনিও চমৎকার। রেসিপি শেয়ার করেছেন ঠিকই কিন্তু, সেটা একটা গল্পের মাধ্যমে, স্মৃতিচারণ করতে করতে। এটাই বইটির মাধুর্য্য বাড়িয়েছে। ইন্দিরার লেখাতে, ঈশ্বর গুপ্ত মহাশয় আছেন, আছে ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গ। আছে মঙ্গল কাব্যের ও চৈতন্যচারিতামৃতর রেফারেন্স। রান্নার প্রসঙ্গে, খাবারের আলোচনায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত, রাসবিহারী বসু, বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়, বাসন্তী দেবী, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, অমৃতলাল বসু কে নেই... কত যে আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক হতে পারে একটি সাধারণ রান্নার বই তা না পড়লে বোঝা যায়না। গবেষণা যে শুধু তথ্যপূর্ণ তা নয়, তা লেখাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। আমি কুর্নিশ জানাই লেখিকার অধ্যাবসায় ও রান্নার প্রতি আবেগ কে।
বিশ্বায়নের দৌলতে, আজ আমরা কত জানছি আর শিখছি, শুধু তাই নয়, পুরাতন ও আধুনিক এর একটা মেলবন্ধন করতে পারছি। সেটা যে আহারেও প্রযোজ্য, তার নিদর্শন হল ৫১ বর্তী । হেঁশেলে বৈচিত্রর অভাব নেই, আমাদের গুরুজনেরা সেই বৈচিত্র কে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রজন্ম ও আগামী আরও অনেক প্রজন্মকে কত কি শিখিয়ে গেছেন। এই ভাবেই তো আমাদের সমাজ এগিয়ে চলছে।
সবার শেষে, খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়লাম, সপ্তকন্যার রান্নার ২৫ টি পরামর্শ ও কৌশল। প্রতিটি প্রজন্মের জন্য এটা জরুরি। না খেয়ে তো থাকা যাবে না, আর খেতে গেলে, রান্নাও করতে হবে, আর রান্না করতে গেলে, হেঁশেল ও সামলাতে হবে। ইন্দিরা বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবনে দেখা সুরাঁধিয়ে সপ্তকন্যাকে। কি ভালো যে লাগলো, আমি নিশ্চিত, তাঁরা লেখিকাকে অনেক আশীর্বাদ করছেন ওপর থেকে আর তাঁদের স্নেহের ছায়াতে ঘিরে আছেন।
ঠিক করেছি, বাঙালির হারানো ৫১ পদের মধ্যে, দু চারটে তো রাঁধবই বিশেষ দিনে। সত্যিই ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের এই বইটি সব মেয়েদের পড়া উচিৎ। মন ভরে যাবেই।