কোলকাতার ভীড়ভাট্টা ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পুজোটা কাটাবো এবার এই ঠিক ছিল । ছেলের ফাইনাল ইয়ারের ইন্টার্নশিপ চলছে এখানে । সে ছুটি পাবেনা তাই আমাদের একসাথে পুজোর ছুটি কাটাতে যাওয়া । সকাল
তখন আমরা জামশেদপুরের বাসিন্দা ।
ওখানকার পুজোতে সেবার নবমীর দিন আগমনী গান গাইতে উঠেছি পুজোমঞ্চে, মাদুর্গার পাশে । নাম ঘোষণার পর স্টেজে উঠতেই হৈ হৈ ।
আমার নাছোড় পুত্রের বাবা তাকে দর্শকাসনে বসানোর চেষ্টা করছেন আর সে মঞ্চে উঠবেই..
চারবছরের পুত্রটি ধীরে পায়ে এসে আমার পাশে টপ্ করে বসে পড়ল । আমি হতবাক!
অনুষ্ঠানের কতৃপক্ষদের সে বলল মায়ের পাশে বসে রা'টিও কাটবেনা, তাকে বসতে অনুমতি দেওয়া হল ।
আমার গান অবধি গম্ভীর হয়ে, হাতে ক্যাপবন্দুক নিয়ে ঘটের মতন বসে রইল চুপটি করে
মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় তাকে শুধালাম, এটা তুমি কি করলে? বাবার কাছে বসলেই পারতে..
সে বলল- দুষ্টু অসুর যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে ! বীরপুরুষ আবৃত্তির সময় তুমিই তো বলেছিলে তোমার পাশে এমনি করে থাকতে!
আমি মনে মনে আওড়ে নিলাম "ভাগ্যি খোকা ছিল মায়ের সাথে" !
....
দিন কয়েকের মত শিকেয় তোলা রইল মহানাগরিক কোলাহল । কিন্তু তেলেঙ্গানা পৃথকীকরণের জেরে আর ধেয়ে আসা ঘূর্ণাবর্তের আশঙ্কায় আহ্লাদে আটখানা হতে পারলাম না । একটু মনখারাপও হোল তবুও ভালো লাগল ছুটির আনন্দে । ছুটি যেমনই হোক আর পুজোর ছুটি সব ছুটির থেকে অন্যরকমের । তবে খুব মিস করছিলাম ঢাকের শব্দ । এবছর আশ্বিনের শারদপ্রাতে অকাল শ্রাবণের চোখরাঙানি এ শহরকেও তাড়া করে চলেছে । বৃষ্টি শরতের মুখে একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছে । মনখারাপের বাঁধ ভেঙে কবিতায় পেয়ে বসল আমায় ।
দুর্গা তোমার দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি কেন বলো ?
দুর্গা তোমার দৃষ্টি সুদূরে আঁধারে কিম্বা আলো ।
দুর্গা তোমার ঘামতেল আজ বিষণ্ণতার ছোঁয়া
ধুলোমুঠি শাড়ি মলিন আঁচল তবুও শিউলি ধোয়া ।
দুর্গা তোমার দৃষ্টি সুদূরে আঁধারে কিম্বা আলো ।
দুর্গা তোমার ঘামতেল আজ বিষণ্ণতার ছোঁয়া
ধুলোমুঠি শাড়ি মলিন আঁচল তবুও শিউলি ধোয়া ।
...
রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো |
সপ্তমীর শারদপ্রাতের সূচনায় মনখারাপের মেঘ জমেছে । কলাবৌ স্নানের কোনো লক্ষণ নেই এ শহরে । হয়ত বা হচ্ছে তার প্রস্তুতি দূরে কোথাও , বহু দূরে । মনে পড়তে লাগল ঢাক, শাঁখের আওয়াজ.. ন'টি উদ্ভিদ চারা দিয়ে তৈরী কলা-বৌকে স্নান করিয়ে, লাল পাড় সাদা শাড়ী পরিয়ে মা দুর্গারূপে পুজো করা ।
গোলকুন্ডা ফোর্ট |
আমারা রয়েছি হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটির কাছে কোন্ডাপুরে । সেখান থেকে সপ্তমীর দিন গেলাম হুসেন সাগর নামে এক বিশাল লেকে । কি পরিচ্ছন্ন!
হুসেন সাগরের বুদ্ধমূর্তি |
আর সেখানে ঐ বিশাল জলাশয়ের মধ্যে একটি অভিনব বুদ্ধমূর্তি দেখতে যাওয়া হল লঞ্চে করে । তারপর গোলকুন্ডা ফোর্ট ও চারমিনার ।
চারমিনার |
হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের দুর্গাপুজো |
মহাষ্টমীর ভোরে স্নান সেরে নিয়ে হায়দ্রাবাদেও নতুন শাড়ি । তারপর আবার রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজোয় সামিল হলাম ।ঠিক বেলুড়মঠের মত একচালার হলুদ মূর্তি মা সহ তাঁর পরিবারের । মূল মন্দিরে ঠাকুর রামকৃষ্ণ টুকটুকে লাল দক্ষিণি পট্টবস্ত্রে, মা সারদা টুকটুকে লাল জরিপাড় মাহেশ্বরী শাড়িতে ও স্বামী বিবেকানন্দ গেরুয়া রঙের কাঞ্জিভরম ধুতিতে । চন্ডীপাঠের সকাল । মন্ত্রমুগ্ধ আবহ । স্তোত্রপাঠের পর আরতি, পুষ্পাঞ্জলি । সবকিছুই বেলুড়মঠের রীতি অনুসারে । কিন্তু ভীড় কম বলে আরো যেন কাছে পাওয়া সেই দুর্গাপুজোকে । কোলকাতার পুজোতে যেন অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি বড্ড বেশি কৃত্রিম মনে হয় আজকাল । এরপর হোমযজ্ঞ । তারপর প্রসাদ বিতরণ । অভিনব ভোগপ্রসাদ । মাঠের ওপর পেতলের বিশাল হাঁড়িতে ঘিভাত বসেছে কাঠের জালে । আর সেই ঘিভাতের সাথে তেলুগু সবজী, চাটনী, পাঁপড় ও মিষ্টি ডালপুরী । পরিতৃপ্তিতে ভরপুর মন । হোটেলে ফিরে এসে ডিডিবাংলায় সরাসরি বেলুড়মঠের সন্ধিপুজো দেখতে পেয়ে গেলাম ।
মনখারাপ হল তীব্র গতিতে ছুটে আসা ঘূর্ণিঝড় পিলিন এর কথা শুনে । অন্ধ্র ও উড়িষ্যার উপকূলে ধেয়ে আসছে সেই ঘূর্ণাবর্ত । সে রাতে অজানা আশঙ্কায় ঘুম এলনা দুচোখে ।
বৃষ্টি কোলকাতাকে পুজোতে মুক্তি দেয়নি কিন্তু শরতের আকাশের অনেকটা নীল দাক্ষিণাত্য মালভূমির এই শহরে ধরা দিল । পিলিন অষ্টমীর রাতে ঊড়িষ্যার উপকূলে আছাড়ে পড়েছে এরই মধ্যে । ততক্ষণে পিলিন শান্ত হয়েছে অন্ধ্রে । তবে ঊড়িষ্যায় বিপুল ক্ষতি করেছে ।
সালার জাং মিউজিয়ামের বিখ্যাত ভেলড রেবেকা |
মনে মনে গেয়ে উঠলাম " নবমীনিশি রে তোর দয়া নাই! এত করে সাধিলাম ..."
নবমীর দুপুরে মাংস খাওয়ার রেওয়াজ সব বাঙালী বাড়িতে । কাবাব-বিরিয়ানি-তন্দুরীর শহরে তার জন্য হাপিত্যেশ নেই । অলিগলিতে মুখরোচক দোকান । ঐদিন এ শহরে নবরাত্রির সাজগোজ যেন একটু বেশিমাত্রায় নজরে এল ।
দশমীর দুপুর থেকে বাড়িতে শুরু হয়ে যেত নিমকী-নাড়ু আর ঘুগনীর তোড়জোড় । কত মানুষ আসবে বাড়িতে । কিন্তু এখন কোলকাতায় সেই রেওয়াজ যেন অনেকটাই স্তিমিত । দল বেঁধে যাওয়া হত বিজয়া করতে । প্রবাসে বসে আরো যেন এইগুলো পেয়ে বসে আমাকে । মনে হয় আমি যেন দলছুট এক কোলকাতাইয়া । তবে হাইটেক সিটি ছেড়ে যেতে যেতে কেবল মনে হতে লাগল আমার শহরের কথা । হায়দ্রাবাদ কোলকাতা দুই পুরোণো শহর । কিন্তু এ শহরে শুধু শিল্পের জোয়ার । শেষদিন খেতে গেছিলাম এক রেস্তোঁরায় । সেখানে বাঁকুড়ার এক বাঙালী যুবক হোটেলে কাজ করে । সে বলল তার দুঃখের কথা । দেশ ছেড়ে পুজোর সময় তার মোটেও ভালো লাগছেনা কিন্তু বাঁকুড়ায় পড়ে থাকলে তার সংসার চলবেনা তাই কাজের জন্য দলে দলে ছেলেরা বাঁকুড়া ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পাড়ি দিয়েছে .. সে জানাল । আবারো মনটা ভারি হয়ে গেল তার কথাগুলো শুনে ।
দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকুক কোলকাতার বাঙালী । যদি মাদুর্গা ভবিষ্যতে প্রসন্না হন তবে আমাদের এই শহরেও শিল্পের জোয়ার আসবে । সেই সুপ্ত বাসনা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে ।
আমাদের পরবর্তী পিটষ্টপ ভাইজ্যাগ্-আরাকু ভ্যালিতে । ইষ্টকোষ্টের ধার ঘেঁষে গোদাবরী এক্সপ্রেস ছুটে চলল ।
আদরের নৌকায় প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন