২৪ অক্টো, ২০১৩

বিরিয়ানি, মুক্তো এবং পুজো


কোলকাতার ভীড়ভাট্টা ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পুজোটা কাটাবো এবার এই ঠিক ছিল  । ছেলের ফাইনাল ইয়ারের ইন্টার্নশিপ চলছে এখানে । সে ছুটি পাবেনা তাই আমাদের একসাথে পুজোর ছুটি কাটাতে যাওয়া । সকাল
থেকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকা তার জন্যে । কখন সন্ধ্যে হবে আর তার সাথে বেরুনো হবে । ভাবতে লাগলাম ছোট্টটির কথা । নাছোড় সেই বীরের কথা ।

তখন আমরা জামশেদপুরের বাসিন্দা । 
ওখানকার পুজোতে সেবার নবমীর দিন আগমনী গান গাইতে উঠেছি পুজোমঞ্চে, মাদুর্গার পাশে । নাম ঘোষণার পর স্টেজে উঠতেই  হৈ হৈ ।
আমার নাছোড় পুত্রের বাবা তাকে দর্শকাসনে বসানোর চেষ্টা করছেন আর সে মঞ্চে উঠবেই..
চারবছরের পুত্রটি ধীরে পায়ে এসে আমার পাশে টপ্‌ করে বসে পড়ল । আমি হতবাক!
অনুষ্ঠানের কতৃপক্ষদের সে বলল  মায়ের পাশে বসে রা'টিও কাটবেনা, তাকে বসতে অনুমতি দেওয়া হল ।
আমার  গান অবধি গম্ভীর হয়ে, হাতে ক্যাপবন্দুক নিয়ে  ঘটের মতন বসে র‌ইল চুপটি করে
মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় তাকে শুধালাম, এটা তুমি কি করলে? বাবার কাছে বসলেই পারতে..
সে বলল-  দুষ্টু অসুর যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে ! বীরপুরুষ আবৃত্তির সময় তুমিই তো বলেছিলে তোমার পাশে এমনি করে থাকতে!
আমি মনে মনে আওড়ে নিলাম "ভাগ্যি খোকা ছিল মায়ের সাথে" !
....

দিন কয়েকের মত শিকেয় তোলা র‌ইল মহানাগরিক কোলাহল । কিন্তু তেলেঙ্গানা পৃথকীকরণের জেরে আর ধেয়ে আসা ঘূর্ণাবর্তের আশঙ্কায় আহ্লাদে আটখানা হতে পারলাম না ।   একটু মনখারাপও হোল তবুও  ভালো লাগল ছুটির আনন্দে ।  ছুটি যেমনই হোক  আর পুজোর ছুটি  সব ছুটির থেকে অন্যরকমের । তবে খুব মিস করছিলাম  ঢাকের শব্দ ।  এবছর আশ্বিনের শারদপ্রাতে অকাল শ্রাবণের চোখরাঙানি এ শহরকেও তাড়া করে চলেছে । বৃষ্টি শরতের মুখে একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছে ।  মনখারাপের বাঁধ ভেঙে কবিতায় পেয়ে বসল আমায় । 


দুর্গা তোমার দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি কেন বলো ?
দুর্গা তোমার দৃষ্টি সুদূরে আঁধারে কিম্বা আলো ।
দুর্গা তোমার ঘামতেল আজ বিষণ্ণতার ছোঁয়া
ধুলোমুঠি শাড়ি মলিন আঁচল তবুও শিউলি ধোয়া ।
...

ছোটবেলায় ষষ্ঠীর ভোরে  মা'কে দেখতাম স্নান সেরে এসে প্রত্যেক দরজার মাথায় তেল-হলুদ-সিঁদুরের ফোঁটা দিতে । মা দুর্গাষষ্ঠীর ব্রতকথা পড়ে হাতে প্রসাদ দিতেন ।  সুদূরে বসে সেই স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই । সেই শুভসূচনার সাথে সাথে মায়ের আগমনের শুরু হয়ে যেত  । হোটেলের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাচ্চাদের স্কুল যাওয়ার তাড়া । অফিসকাছারি যাবার কর্মব্যস্ততা ।  কোলকাতার সাথে কোনো তুলনা নেই এ শহরের পুজোর । হোটেলের ব্রেকফাস্ট ব্যুফেতে গিয়ে নিরামিষ ফলাহার সেরে নিলাম ষষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে ।
রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো
 হোটেলের টেলিভিশনে ডিটিএইচ পরিষেবার মাধ্যমে আকাশবাণী কলকাতা পেয়ে দিব্যি খুশি হলাম । একে একে পুরোণোদিনের গান আর কলকাতার পুজোর আপডেট পেতে থাকলাম । প্যান্ডেল হপিং না করেই সেলেবদের খুচরো গসিপ আর বাংলা গান এর চেয়ে ভালো ছুটি কাটানো কিসে হতে পারে ? মাঝেমধ্যে ডিডিবাংলায় পুজো পরিক্রমা দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটালাম । আমার মনের ছুটির ঘন্টা আর ঢাকের বাদ্যি ততক্ষণে কোলকাতাকে এনে দিয়েছে চোখের সামনে । মায়ের আমন্ত্রণ, অধিবাস, বোধন চলছে ।
 সপ্তমীর শারদপ্রাতের সূচনায়  মনখারাপের মেঘ জমেছে । কলাবৌ স্নানের কোনো লক্ষণ নেই এ শহরে । হয়ত বা হচ্ছে তার প্রস্তুতি দূরে কোথাও , বহু দূরে । মনে পড়তে লাগল ঢাক, শাঁখের আওয়াজ.. ন'টি উদ্ভিদ চারা দিয়ে তৈরী কলা-বৌকে স্নান করিয়ে,  লাল পাড় সাদা শাড়ী পরিয়ে   মা দুর্গারূপে পুজো করা ।   
গোলকুন্ডা ফোর্ট

আমারা রয়েছি হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটির কাছে কোন্ডাপুরে । সেখান থেকে সপ্তমীর দিন গেলাম হুসেন সাগর নামে এক বিশাল লেকে । কি পরিচ্ছন্ন! 
 
হুসেন সাগরের বুদ্ধমূর্তি 

আর সেখানে ঐ বিশাল জলাশয়ের মধ্যে একটি অভিনব বুদ্ধমূর্তি দেখতে যাওয়া হল লঞ্চে করে । তারপর গোলকুন্ডা ফোর্ট ও চারমিনার ।
চারমিনার
 সপ্তমীর দিন আমাদের বাড়িতে খুব রান্নাবান্না হত ।   বিশেষ আমিষ পদ.. মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সেই  স্মৃতি নিয়ে পৌঁছে গেলাম   হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে পুরোণো রেস্তোঁরা প্যারাডাইসে । বিরিয়ানি   রায়তা ও কাবাব দিয়ে সপ্তমীর ভোজ সারা হল । সন্ধ্যের ঝুলে ডোমালগুডায় রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো দেখতে গেলাম । সন্ধ্যারতির পর পোহা প্রসাদ পেলাম । 
হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের দুর্গাপুজো
 এবার পাশেই ইন্দিরা পার্কের উল্টোদিকে  হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের ৭২বছরের পুরোণো পুজো দেখতে গেলাম ।  ওখানকার পুজোতে গিয়ে পুরোণো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা একটা বিরাট প্রাপ্তি ।   বাঙালী যেখানেই থাকুক ঠিক চেষ্টা করে যায় তার সাহিত্য-কলা-কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে ।বিরিয়ানি আর মুক্তার শহর  হায়দ্রাবাদও তার ব্যাতিক্রম নয় ।  সেখানেও এক আকাশের নীচে সব বাঙালী মানুষ  গান, নাচ, নাটকের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোকে পালন করছে । তবে এদের কোনো পুজোতেই কোলকাতার মত অনিয়ন্ত্রিত ভীড় নেই বা অহেতুক সেলিব্রিটি প্রদর্শনের হিড়িক নেই । আর নেই থিম পুজোর জাঁকজমক ।  কোলকাতার এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন। শুধু বেঁচে র‌ইল স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মহাষ্টমীতে সেরা পোষাকটি পরে অঞ্জলি দেওয়া । সারা বছরের মত মায়ের কাছে বাঙালীর যত কিছু চাওয়া  । "রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি"... ইত্যাদি আরো কত কিছু । 

মহাষ্টমীর ভোরে স্নান সেরে নিয়ে  হায়দ্রাবাদেও নতুন শাড়ি । তারপর আবার রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজোয় সামিল হলাম ।ঠিক বেলুড়মঠের মত একচালার হলুদ মূর্তি মা সহ তাঁর পরিবারের । মূল মন্দিরে  ঠাকুর রামকৃষ্ণ  টুকটুকে লাল দক্ষিণি পট্টবস্ত্রে, মা সারদা টুকটুকে লাল জরিপাড় মাহেশ্বরী শাড়িতে ও স্বামী বিবেকানন্দ গেরুয়া রঙের কাঞ্জিভরম ধুতিতে ।    চন্ডীপাঠের সকাল । মন্ত্রমুগ্ধ আবহ । স্তোত্রপাঠের পর  আরতি, পুষ্পাঞ্জলি ।  সবকিছুই বেলুড়মঠের রীতি অনুসারে । কিন্তু ভীড় কম বলে আরো যেন কাছে পাওয়া সেই দুর্গাপুজোকে । কোলকাতার পুজোতে যেন অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি বড্ড বেশি কৃত্রিম মনে হয় আজকাল । এরপর হোমযজ্ঞ । তারপর প্রসাদ বিতরণ । অভিনব ভোগপ্রসাদ । মাঠের ওপর পেতলের বিশাল হাঁড়িতে ঘিভাত বসেছে কাঠের জালে । আর সেই ঘিভাতের সাথে তেলুগু সবজী, চাটনী, পাঁপড়  ও মিষ্টি ডালপুরী । পরিতৃপ্তিতে ভরপুর মন ।  হোটেলে ফিরে এসে ডিডিবাংলায় সরাসরি বেলুড়মঠের সন্ধিপুজো দেখতে পেয়ে গেলাম ।
মনখারাপ হল তীব্র গতিতে ছুটে আসা ঘূর্ণিঝড়  পিলিন এর কথা শুনে । অন্ধ্র ও উড়িষ্যার উপকূলে ধেয়ে আসছে সেই ঘূর্ণাবর্ত । সে রাতে  অজানা আশঙ্কায় ঘুম এলনা দুচোখে ।
 বৃষ্টি কোলকাতাকে পুজোতে মুক্তি দেয়নি  কিন্তু শরতের আকাশের অনেকটা নীল দাক্ষিণাত্য মালভূমির এই শহরে  ধরা দিল । পিলিন অষ্টমীর রাতে ঊড়িষ্যার উপকূলে আছাড়ে পড়েছে এর‌ই মধ্যে । ততক্ষণে পিলিন শান্ত হয়েছে   অন্ধ্রে  । তবে ঊড়িষ্যায় বিপুল ক্ষতি করেছে ।  
সালার জাং মিউজিয়ামের বিখ্যাত ভেলড রেবেকা 
 নবমীর সকালে এ শহরের আরো এক মুখ্য আকর্ষণ সালার-জাং মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে থকে যাওয়া আর নবমীনিশিতে আবার মন উচাটন কোলকাতার ধুনুচিনাচের জন্য । আর সেই সোনার প্রতিমা ভাসানের সুর যেন বেজে উঠল কানে কানে ।

 মনে মনে গেয়ে উঠলাম " নবমীনিশি রে তোর দয়া নাই! এত করে সাধিলাম ..."

নবমীর দুপুরে মাংস খাওয়ার রেওয়াজ সব বাঙালী বাড়িতে । কাবাব-বিরিয়ানি-তন্দুরীর শহরে তার জন্য হাপিত্যেশ নেই । অলিগলিতে মুখরোচক দোকান । ঐদিন এ শহরে নবরাত্রির সাজগোজ যেন একটু বেশিমাত্রায় নজরে এল ।  
দশমীর দুপুর থেকে বাড়িতে শুরু হয়ে যেত নিমকী-নাড়ু আর ঘুগনীর তোড়জোড় । কত মানুষ আসবে বাড়িতে । কিন্তু এখন কোলকাতায় সেই রেওয়াজ যেন অনেকটাই স্তিমিত । দল বেঁধে যাওয়া হত বিজয়া করতে । প্রবাসে বসে আরো যেন এইগুলো পেয়ে বসে আমাকে । মনে হয় আমি যেন দলছুট এক কোলকাতাইয়া । তবে হাইটেক সিটি ছেড়ে যেতে যেতে কেবল মনে হতে লাগল আমার শহরের কথা । হায়দ্রাবাদ কোলকাতা দুই পুরোণো শহর । কিন্তু এ শহরে শুধু শিল্পের জোয়ার । শেষদিন খেতে গেছিলাম এক রেস্তোঁরায় । সেখানে বাঁকুড়ার এক বাঙালী যুবক হোটেলে কাজ করে । সে বলল তার দুঃখের কথা । দেশ ছেড়ে পুজোর সময় তার মোটেও ভালো লাগছেনা কিন্তু বাঁকুড়ায় পড়ে থাকলে তার সংসার চলবেনা  তাই কাজের জন্য দলে দলে ছেলেরা বাঁকুড়া ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পাড়ি দিয়েছে .. সে জানাল ।   আবারো মনটা ভারি হয়ে গেল তার কথাগুলো শুনে ।
দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকুক কোলকাতার বাঙালী । যদি মাদুর্গা ভবিষ্যতে প্রসন্না হন তবে আমাদের এই শহরেও শিল্পের জোয়ার আসবে ।  সেই সুপ্ত বাসনা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে ।   
আমাদের পরবর্তী  পিটষ্টপ ভাইজ্যাগ্-আরাকু ভ্যালিতে ।  ইষ্টকোষ্টের ধার ঘেঁষে  গোদাবরী এক্সপ্রেস ছুটে চলল ।  
আদরের নৌকায় প্রকাশিত  

কোন মন্তব্য নেই: