১৫ এপ্রি, ২০১৪

কলকাতার বোশেখ, বোশেখের কলকাতা

বার দেখতে দেখতে আমরা নতুন বছরের দোরগোড়ায়। নতুন বাড়ির হাউস ওয়ার্মিং পার্টির তোড়জোড় শুরু। সারা বছরের পুরনো খাতাপত্তর ঝেড়েঝুড়ে তাকে গুছিয়ে, সকলের বাড়িতেই এখন বসন্ত বিদায়ের তোড়জোড়। আবার গরমের বিকেলে গা ধুয়ে পরে নেব মলমল শাড়িখানা, বরষার সান্ড্যাক চটিজোড়া যত্ন করে রেখে দেব, ভাদ্রের রোদে পুরনো বালুচরি রোদ খাওয়াব, শীতের পশমিনা-বালাপোশ মথ বলের গন্ধে ভরপুর করবে। ফাগুনের আগুন নিভে যাবে দোলের সঙ্গে সঙ্গে আর তার সঙ্গেই চৈত্রসেলের চিত্কার! চৈত্রমাস পড়তে না পড়তেই পুরনো বছরটার পাততাড়ি গোটানোর ধান্ধা। নতুন বছর আসবে বলে ঘর ঝাড়াপোঁছা, সেই অছিলায় নতুন জামা, আনন্দে হইহই করে হ্যাং আউটের প্ল্যান, নবপঞ্জিকা, হালখাতা আর নতুন ক্যালেন্ডার। সেইসঙ্গে বাঙালির ঝালিয়ে নেওয়ার পালা সেই বং-কানেকশন। কী করে ভুলি আমরা? যত‌ই ইংরেজি ছবি দেখি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল কথা বলি আর গোগ্রাসে কন্টিনেন্টাল খাবারদাবার গিলি না কেন, আদতে আমরা ঝোল-ঝাল-অম্বলের ভক্ত।

চৈত্রশেষে অকালবোশেখি পাওয়ার মতো বাঙালির আরও একটা বড় প্রাপ্তি হল পয়লা বৈশাখের অপ্রত্যাশিত নতুন জামাকাপড়, নিদেন একটা গানের সিডি অথবা একখানা ব‌ই। ঠিক তক্ষুণি মনে হয় ছোটবেলার কথা। মনে মনে আমাদের বয়স কিন্তু বাড়ে না। সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাচের গ্লাস ওপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর সঙ্গে বগলদাবা করে মিষ্টির বাক্স। ঠাকুমার জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার। দিদিমার জন্য বুকস্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা, তা-ও নিতে হবে মনে করে। কমপক্ষে চারটি দোকানের মিষ্টির বাক্স একত্র জড়ো করে বাড়ি ফিরে বসবে আমাদের সান্ধ্য বৈঠকি। সঙ্গে গান তো হাতের পাঁচ। সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে। সে দিন মাছবাজার ধুয়েমুছে সাফ এক্কেবারে। মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্য ফিনাইল, ধূপ-ধুনো কত্ত সব কায়দা। আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে বসেছেন জম্পেশ করে। আমি আছি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া, নতুন ছিটের নরম ফ্রকে। প্রথম বার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি-তে। সে গুড়ে বালি! পয়লা নম্বর মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সে-ও!

পয়লা বোশেখের কথা মনে হলেই বেশি করে মনে পড়ছে হাতিবাগান বাজারের কথা। আমার কলেজবেলার পাঁচ-পাঁচটা বছরে এই হাতিবাগানের শাড়ির দোকানগুলো থেকে হইহই করে ভিড় মাথায় নিয়ে বন্ধুরা মিলে শাড়ি কিনতে যাওয়া, সে-ও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আর সেই সঙ্গে রূপবাণী-তে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে সিলভার ভ্যালির মুচমুচে কবিরাজি কাটলেট? ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউসে তখন ভাল ভাল ইংরেজি ছবিগুলো আসত। বাবা নিয়ে যেতেন দেখাতে। টাওয়ারিং ইনফার্নো, টোয়েন্টি থাউসেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, টেন কমান্ডমেন্টস, বেনহার— কত ছবি না দেখা হয়েছে ওই হলে। আর ফেরার পথে ফড়েপুকুরের সেই অমৃতর পয়োধি?

আর মনে পড়ে স্টার থিয়েটারের কথা। সে বার কলেজ থেকে ফেরার পথে সুপ্রিয়াদেবীর "বালুচরী" নাটকের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম বাড়ির সকলের জন্য। পর দিন পয়লা বৈশাখে সকলে মিলে নাটক দেখে বাড়ি আসা হল। কি দারুণ নাটক! যেমন কাহিনি তেমনই অভিনয়। ফিনিক্স পাখীর মতো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে আবার সেই ছাই থেকে উঠে এসেছে স্টার। স্টার থিয়েটারের সিনেমায় উত্তরণ হয়েছে। ভাবলেও নস্ট্যালজিয়ায় সেই নাটক শুরু হওয়ার মিউজিকাল সোনাটা কানে বাজে।

হেদুয়ায় কলেজ গেটের পাশে রোজ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত মতিদা। এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা। তার ফুচকা যেমন বড় বড়, গোল্লা গোল্লা ও মুচমুচে আর তেমনই সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন। আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে। বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকা খাওয়া নিয়ে। কিন্তু মতিদা মানুষটা আর তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। মতিদার ছিল একটাই স্লোগান, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও", "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না। কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরি এই তেঁতুলজল।"

আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে। দিদিকে বলতাম "এক দিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব।" তা সে আর হয়ে উঠত না। সে বার পয়লা বোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন। আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি, পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে। এই হল পয়লা বৈশাখের হাতিবাগান! যেখানে অজস্র জিনিস আর তার হাতছনিকে উপেক্ষা করা যায় না। এ দিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে। হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে। বাসে উঠব যে সে পয়সাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি। সেখানে মতিদা তখনও দাঁড়িয়ে। দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়াল, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো..."

দিদিকে কথা দিয়েছিলাম এক দিন ফুচকা খাওয়াব। মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে। আমি বললাম, "না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা।" মতিদা বলল, "খাও খাও, কিচ্ছু হবে না।" বললাম, "না না, সে কথা নয়।" মতিদা  বলল, "মা বকবে?” বললাম, "না না, পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে।" মতিদা বলল, "কাল দিও, আগে তো খাও।" আমি বললাম, "বাড়ি ফেরার পয়সাও নেই।" মতিদা বলল, "আমি দিচ্ছি, কাল দিও।" আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম। এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনও। আরও যেন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, মুচমুচে ফুচকা! আরও পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন!

এই পয়লা বোশেখ এলেই আমার মতিদার কথাও ভীষণ মনে পড়ে!

আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্টারনেট এডিশান ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪ 

১৩ এপ্রি, ২০১৪

বৈশাখী শুভেচ্ছা !

আবার ৩৬৫ দিনের পুরোণো একটা বাংলা বছর পাততাড়ি গোটাতে ব্যাস্ত । একদিকে লোকসভা ভোটের উত্তেজনার পারদ চড়ছে। অন্যদিকে গ্রীষ্ম তার চোখরাঙানি দেখাতে শুরু করেছে।  তার মাঝে চৈত্রসেলের রমরমা। ফুটপাথে “সেল, সেল”  চীতকারে ঝালাপালা শ্রবণেন্দ্রিয়ের দুদন্ড জিরেন হয় শপিংমলের “বাই ওয়ান-গেট ওয়ানে” চোখ বুলিয়ে।  আইসক্রিম, ঠান্ডাইয়ের সুখে আত্মহারা পাবলিক। সবকিছু অনুষঙ্গের সখ্যতা একটাই কারণে। তা হল বাংলা বর্ষবরণ।  ঠান্ডা পানীয়, ফ্রুট জুস, আইসক্রিম, নতুন জামা, স্প্রিং ক্লিনিং সবকিছুই মনে করিয়ে দেয় বৈশাখের আগমনী আর চৈত্রের স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে দেওয়াকে।  মনে করিয়ে দেয় আবার সেই দাবদাহের কথা অথবা রবীন্দ্রজয়ন্তীর কথা। অকালবোশেখির হঠাত মেঘ কিম্বা কালবৈশাখির পরিকল্পনা। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে ভেসে আসে সাদা ফুলের গন্ধ। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুর সূচনা করে নতুন দিনের। নতুন বছরের। প্রকৃতি সতী গ্রীষ্মের সাজ সেজে বসে থাকেন রৌদ্রের ধুনি জ্বালিয়ে।
কারণ সে না এলে তো বর্ষার নো এন্ট্রি । তাই তো এই বর্ষবরণ অথবা বৈশাখ-উত্সব।  এই  নববর্ষের প্রাক্কালে মহানগরের ফুটপাথে   হকারময়তার বাড়বাড়ন্ত  । ঠিক গরমের দাবদাহের মত সহ্য করতে হয় যা। ভোটের রাজনীতি উচ্ছেদ করেনা তাদের। কারণ সবার উপর মানুষ সত্য। সবার ওপরে ভোটব্যাঙ্ক। কারো নতুন ব‌ইখাতা কারো হালখাতা। লক্ষ্মী-গণেশের জোড়া পুজো, শুভলাভের আশায়। আবারো হিপোক্রেসি। লোক ঠকানোর কৌশলে ঠাকুরকে বছরের শুরুতেই অগ্রিম দাদন। সেও মেনে নিতে হয় গরমের অসহনীয় তাতের মত। বাজারের থলিতে চৈত্রের বুড়ো সজনে ডাঁটায় ফ্যাশন আউট কারণ সদ্য সমাপ্ত গাজনের ঢাকের কাঠি পড়ে গেছে। আসলে তা বুড়িয়ে যায়, বাঙালির চিবুতে কষ্ট হয় কিন্তু দোহাই ভগবানের। আমরা বাপু নববর্ষের শুভ মহরত বুঝি নতুন খাওয়াদাওয়ায়, নতুন ব‌ই রিলিজে, নতুন ছবি মুক্তিতে। প্যাপিরাসের নববর্ষের প্রাক্‌কথন সেই কারণেই।  তাই সকলের জন্য র‌ইল নতুন বছরের বৈশাখী শুভেচ্ছা ।

২৩ মার্চ, ২০১৪

লড়াকু লেখিকা'র মনোলগ


 
ফেসবুকে আমার প্রোফাইল ডেসিগনেশন হল "লড়াকু লেখিকা" । সেই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আর কৌতুহলী জনগণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন ইনবক্সে। "আচ্ছা দিদি, আচ্ছা ম্যাম, আচ্ছা বন্ধু !!! এই "লড়াকু লেখিকা"র অর্থটা কি স্পষ্ট করে বলবেন? আপনি কি লড়াই করে লেখেন না কি লেখার জন্য লড়াই করেন ? অথবা দুটোই..." ব্যাপারটা যদি বুঝিয়ে বলেন। আমিও বেশ মজা পাই এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে। কিন্তু আমার ফেসবুকের লেখক-কবি বন্ধুরা হয়ত এই "লড়াকু লেখিকা" শব্দ দুটির অর্থ বেশ ভালোই বোঝেন আশা করি। বাংলাভাষায় লেখক-কবির সংখ্যা এত‌ই বেশী যে আমাদের প্রকৃত অর্থেই প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। ওয়েবে লিখি আমরা অনেকেই। ছাপ পত্রিকাতেও লিখি অনেকে। কিন্তু ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকরা সেই অর্থে অনেক বেশি লিবারাল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাবহার করেন লেখকদের সাথে। অন্যদিকে ছাপা কাগজে বা ম্যাগাজিনে বছরের পর বছর এল্খা জমা পড়ে থাকে। ফোন করে বা মেল করে নিজের লেখাটি প্রকাশের যোগ্য কিনা তা জিগেস করাটাও তাদের নাপসন্দ। কেউ কেউ আবার জিগেস করলে চোখ রাঙাতেও দ্বিধা করেন না। উঠতি লেখকরা যেন অপাঙতেয়। আর নামীদামী লেখকদের সাথে পঙতি ভোজনে বসানোটাও যেন তাঁদের কাছে একটা ছুঁতমার্গের আওতায় পড়ে। ছাপা পত্রিকায় লেখা থাকে..."লেখা পাঠান এই বিষয়ে, এত শব্দের মধ্যে..."
তাদের মত করে কাস্টমাইজড সার্ভিস দিয়েও সেই লেখা যখন প্রকাশিত হয় তখন লেখক তো আশা করতেই পারেন তাঁর উপযুক্ত সাম্মানিক। কিন্তু বহুদিন বাদে প্রশ্ন করলে তাঁরা উত্তর দেন "আমরা কেবল মাত্র আমন্ত্রিত লেখকদেরই সাম্মানিক দি " তাহলে মাননীয় সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিন প্রায়শঃই কেন লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন তা বুঝতে পারলামনা। তাহলে কি কেবলমাত্র চেনা-পরিচিত লেখকদের লেখা ছাপা হলেই তাঁরা সাম্মানিক আশা করবেন?  অবিশ্যি ব্যাতিক্রমী কিছু পত্রিকাও আছে । যাঁদের কাছ থেকে না চাইতেও বাড়ির ঠিকানায় সাম্মানিক হাজির হয়ে যায়।  
 এই ধরণের ছোটখাটো লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের মত লেখকদের তো জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হয় তাই নয় কি! আর চলতেই থাকে কাগুজে পত্রিকা ভার্সেস ই-পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর লড়াইও।
আমার মত এহেন "লড়াকু লেখিকা"র একটি সাক্ষাতকার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি ই-পত্রিকায়। আশাকরি যারা আমাকে ইনবক্সে প্রশ্ন করেন তারা এর সদুত্তর পাবেন।  

১০ ফেব, ২০১৪

ভীম-একাদশী


মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে দক্ষিণ বঙ্গের একটি বহুপ্রচলিত গ্রাম্যরীতি হল ভৈম-একাদশীর ব্রত পালন । মাহাভারতের ভীম এবং একাদশীর এই যোগসূত্র কি এবং কেন সেই নিয়ে এই আলোচনা । 
হিন্দুঘরের বিধবা কুন্তী নেয়েধুয়ে একাদশীর উপবাস করেন । মাঘমাসের প্রচন্ড ঠান্ডায় পুকুরের ঠান্ডাজলে কেমন করে স্নান করবেন তা ভেবে কুল পান না । কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেও ঐ ঠান্ডা জলে তাঁকে নামতে হ'ল । স্নান সেরে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কুন্তী ঘরের  দিকে আসছেন । তাঁর মধ্যমপুত্র ভীমের সাথে দেখা হল । ঠান্ডায় কাবু মা'কে দেখে শীতের ওপর ভীমের বড় রাগ হ'ল ।  সে তখন লাঙ্গল কাঁধে ক্ষেতে যাচ্ছিল । মায়ের কষ্টকে বরদাস্ত করবেন না তাঁর মত বড় বীর । ফাল থেকে লাঙ্গলকে খুলে নিয়ে আগুণে কশকশে করে গরম করে "জয় কৃষ্ণ" বলে সেই লাঙ্গলের ফালকে পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে দিলেন । আর দেখতে দেখতে শীত পালিয়ে গেল যেন । পান্ডবসখা কৃষ্ণ ভক্ত ভীমের মনস্কামনা পূর্ণ করলেন । হঠাত ভীম মায়ের দিকে চেয়ে দেখেন, কুন্তী খুব আরাম বোধ করছেন । 

এদিকে জলের দেবতা হলেন বরুণদেব ।  পুকুরের জলে আগুণ গরম লাঙলের ফাল ডুবিয়ে জলের গরম তাত সহ্য হয়নি একটুও । বরুণ সেই রাগে দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে দৌড়ে গেলেন পুকুরের জলের তাত জুড়োনোর আর্জি জানিয়ে । কৃষ্ণের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন বরুণদেব ।  কৃষ্ণের দয়া হল ।
কৃষ্ণ বললেন :  বরুণ তোমার গায়ের জ্বালা জুড়োনোর একটাই উপায় । মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে ভীম যদি এই ব্রতের পালন করে তবে তোমার জ্বালা জুড়োবে । তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত দেহতাত কমে যাবে ।
এই কথা শোনামাত্র শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে বরুণদেব  দৌড়ে গেলেন ভীমের কাছে । বনের মধ্যে দেখা হল ভীমের সাথে । একাদশীর ব্রতের কথা ভীম  অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন । অগ্নিদগ্ধ বরুণদেবের গাত্রজ্বালা উপশম হল । 
মহাভারতের ভীম নাকি দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন । 
 পঞ্চপান্ডব এই গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বনবাসে চলেছিলেন । সে কথার উল্লেখ কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতে পাওয়া যায় ।  কুন্তী পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন সেই জঙ্গলেই । আর সেখানেই উপজাতি পরিবারের রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন হিড়িম্বা এসে উপস্থিত হল ।  মহা উল্লাসে নরখাদক হিড়িম্ব তার কাজ সারতে পঞ্চপান্ডব সহ মাতা কুন্তীকে সংহার করতে উদ্যত হল আর মহাবলী ভীমসেন তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ।   হিড়িম্বকে বধ করে ভীমসেন তার দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর সাথে তার পর ভীমের প্রণয় ও গান্ধর্ব মতে তাকে বিয়ে ( এবং অবশ্যই সেই সময় বিয়ে না করে উপায়ও ছিলনা ভীমের, কারণ অরণ্যে শয্যা পেতে উপজাতিদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহবাস না করে কি উপায় থাকে! ) স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকালে "মেদ" উপজাতির বাসভূমি হিসেবে মেদিনীপুর ভূখন্ডর নাম  এই ঘটনার সাক্ষী বহন করছে খড়গেশ্বর ও তার অনতিদূরেই হিড়িম্বেশ্বরী কালীর মন্দির যা পুজো করতেন মহাভারতের ভীমের পত্নী হিড়িম্বা । অতএব উপজাতির আবাসস্থল হিসেবে এই তথ্যটিও ফেলে দেবার নয় ।   

হিড়িম্বার সাথে এইখানেই  তার আলাপ । তাই ভীমের পুজো করার জন্যই ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ভীম-একাদশীর ব্রত পালন করেন ।  
এই প্রচলিত গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন দেখি ভীমের মাতৃভক্তি ঠিক তেমনি দেবলোকেও দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিপত্তি বা এখনকার "দাদাগিরি" ও বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের  ।   
  বাংলার লোকসংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ভীমপুজোয় এই বিপুল আয়োজন আর আড়ম্বর দেখে মনে মনে বাঙালী বলে গর্বিত বোধ হয় । দশাস‌ই ভীমসেনের এই মূর্তি যেন মেলার একাই একশো। মাথাভর্তি কুঞ্চিত কেশ, শ্বশ্রূগুম্ফ সম্বলিত পৌরুষ যেন চিরন্তন বীরত্বের প্রতীক । কোথাও ইনি ভীমসেন, কোথাও বা খেত্তী ভীম, হালুয়া ভীম আবার কোথাও হুলা ভীম কিম্বা চাষী ভীম । কিন্তু সেই মহাভারতের মধ্যমপান্ডব স্থান-কাল-পাত্রভেদে যুবশক্তির বহিঃপ্রকাশ।  আর সর্বোপরি ভীমের এই পুজো যেন সমগ্র দক্ষিণবাংলার কৃষিপুজো কারণ তিনি তো আদতে পবনপুত্র ।  বায়ু আর বৃষ্টির হাত ধরে উর্বর হবে বাংলার মাটি। সবুজে সবুজ হয়ে উঠবে আবাদীজমি এই আশায় গাঁয়ের মানুষের এই বিশ্বাসে নতজানু হয়ে ভীমকে প্রণাম জানাই মনে মনে ।  
  এখন প্রশ্ন হল দক্ষিণবঙ্গে কেন ভীমপুজোর এত জনপ্রিয়তা? কৃষি ছাড়াও এখানকার বন্দর নরী তমলুকে একসময় বহু জাহাজ সমাগম হত। চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙার মত অনেক ব্যবসায়ীর পণ্যবোঝাই জাহাজ এসে ভিড়ত হলদিয়া বন্দরে । আবার রফতানি হত ভারতীয় সামগ্রী যবদ্বীপ, সুমাত্রা, বালির দিকে । বাতাসের আনুকুল্যে নিরাপদে,  নির্বিঘ্নে যাতে জাহাজ যাত্রা বা আগমন সফল হয় তাই পবনপুত্র ভীম সহায় । জাহাজ যাত্রা যাতে অগস্ত্যযাত্রার মত শেষযাত্রা না হয় তাই জলদস্যুর আক্রমণের স্বীকার না হওয়ার উদ্দেশ্যে ভীমের পুজো করে পাঠানো হত জাহাজগুলিকে । তাই সেই কারণে দক্ষিণবঙ্গের এই পবনপুত্রের ওপর ব্যবসায়ীদের ছিল প্রগাঢ় আস্থা ।  

২৫ জানু, ২০১৪

জাতিস্মর.. a musical of memories

জানিনা, আমার ভিতর বাহিরে অন্তর অন্তরে সে আছে অর্থাত গান আর লেখা আছে বলেই  জাতিস্মর আমার কাছে একটা কিংবদন্তী বাংলাছবি হয়ে র‌ইল কিনা ।  আমি এই ছবিকে সঙ্গীতের জাতিস্মরময়তা না জাতিস্মরের সঙ্গীতময়তা বলব ভেবে পাচ্ছিনা তবে কাহিনীকার তথা চিত্রনাট্য ও পরিচালক সৃজিতকে অভিনন্দন । 
আমার মাথা থেকে আপাততঃ উত্তম-তনুজার সেই জলসাঘরের যামিনীময়তা উধাও । অনেকেই হয়ত সমালোচনা করবেন প্রসেনজিত ভার্সেস উত্তমকুমারের, মান্না দে আর শ্রীকান্ত আচার্যের। আমি সে সব বিতর্কে না গিয়েই বলছি দেশ-কাল-পাত্র বদলেছে এবং সৃজিত সফল হয়েছেন । প্রসেনজিত, যীশু সবটুকু দিতে পেরেছেন।  আর সর্বোপরি কবীর সুমন ছবির সঙ্গীতের ব্যান্ডমাষ্টার হয়ে প্রমাণ করে দিলেন যে তিনি আরো পারেন । তাঁর জাতিস্মরে এই মেটামরফোসিস সৃজিত ছাড়া সম্ভব হত কি না জানিনা ।
ছবিতে দুএকটা লুপহোল চোখে পড়লেও সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কারসাজি নিমেষে আটকে রেখেছে ছবির টানটান চিত্রনাট্যকে । অনবরত বদলেছে বর্তমান রঙীন থেকে সুদূর অতীতের সাদাকালো  দৃশ্যপট। সাথে সাথে বদলে গেছে কুশীলবেরা । কিন্তু একটুও বুঝতে দেয়নি সেই ট্রানজিশান।  আর সবচেয়ে মনকাড়া হল সেকালে এন্টনিদের কবিগান বা তরজার সাথে এযুগের ব্যান্ডেমোনিয়াম ২০১৪ সমান্তরালভাবে যুগপত ঘটে গেছে দর্শকের চোখের পলক ফেলার অবকাশে । একটুও প্যান্ডেমোনিয়াম নেই । বাংলাব্যান্ডের রকসঙ্গীত থেকে খেউড়-খেমটা,  আধুনিক থেকে এন্টনীর আগমনী, লালন থেকে কীর্তন সব উঠে এসেছে সেই অনবদ্য ট্রানজিশানের মধ্যে দিয়ে । একবার একঝলক রবির ঝলক পেলাম "মাঝে মাঝে তব দেখা পাইয়ের" সেটাও নাড়া দিল মনটাকে  । সুমনের গলায় সেই ওল্ড ওয়ান ইন নিউ বটলের তলানিটুকুও(যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা....  ) সবশেষে আস্বাদ করতে গিয়ে দুফোঁটা জল ফেলে  চোখ মুছে নিলাম আঁচলে আর  একুশে ফেব্রুয়ারীর জন্য মনে মনে প্রণাম জানালাম টিম জাতিস্মরকে । স্মৃতির সরণী বেয়ে কুশল হাজরা পেরুচ্ছিলেন ঢেউ খেলানো সবুজ বাংলা । স্মৃতির মিছিলে হাঁটতে গিয়ে বারবার ঠোক্কর খাচ্ছিলেন বর্তমান ও অতীতের টানাপোড়েনে । তাই ছবির নাম জাতিস্মর সেক্ষেত্রে ফুলমার্ক্স দাবী করে । 
ছবির ট্যাগ লাইন  A Musical of Memories দেখেই মনে হয়েছিল এতসব ।  রূপে ভোলাননি সৃজিতরা, ভালোবাসাতেও নয়। প্যানপানানি প্রেম দিয়েও নয় সত্যিকারের গান দিয়েই দ্বার খুলেছেন ।  তবে রেডিও জকি মহামায়ার সাথে এন্টনির সৌদামিনী মিলে মিশে এক না হলেও বুঝি মন্দ হতনা । 
আমি বাঙালীর  মন কেঁদে উঠেছে বেজাতের এন্টনীর ঘর পুড়েছে তাই । আমি বাঙালী ঘৃণা করেছি মনে মনে সে যুগের বাঙালীদের যাঁরা সেই অনবদ্য কবিয়ালকে ঈর্ষা করেছিলেন । আমি বাঙালী, বাঙালী হয়েও আমার মাতৃভাষার সম্মান করতে পারিনা যা পারে ভিনরাজ্যের রোহিত মেহতা, "গানে ভুবন ভরিয়ে দেব" অনুষ্ঠানের রেডিও জকি মহামায়া আর সর্বোপরি বিজাতীয় এন্টনী ফিরিঙ্গী ওরফে কুশল হাজরারা । প্রতিটি পুঙ্খ-অনুপুঙ্খ ছুঁয়েছে এহেন আমি বাঙালীর মন । আর এক আকাশের নীচে অনেক আলোর মাঝে  কালিকাপ্রসাদ, খরাজ, শ্রীকান্ত আচার্য, অনুপম, রূপঙ্কর,আর আমাদের ঘরের সব ছেলেগুলো যেমন চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য, লক্ষ্মীছাড়ার গাবু, ক্যাকটাসের সিধু, ফসিলসের রূপম ইসলাম  সকলে মিলে বাংলাগানের হালটা যেন আরো শক্ত হাতে ধরে র‌ইলেন ...এ যেন ছবির সাথে বোনাস পাওনা । আর সবার উপরে থেকে গেলেন সেই বংলাগানের কান্ডারী হয়ে কবীর সুমন যিনি একদিন দিশা দেখিয়েছিলেন নবীন প্রজন্মকে।  বানভাসি নক্ষত্র সমাবেশের মাঝে গানভাসি ছবিময়তা । 
তাই সবশেষে বলি বাংলা গানের জয়, বাংলাভাষার জয়জয়াকার নিয়ে এভাবেও ছবি করা যায়!  

৩১ ডিসে, ২০১৩

লাষ্টপোষ্ট ২০১৩


একটু অন্যরকম বর্ষবিদায় । একটু আনমনা বর্ষবরণ । কিছুটা খামখেয়ালীপনায় আর কিছুটা উত্তেজনায় অবগাহন । বড়দিনের পরেপরেই এসেছি বোলপুরের এক নিরিবিলি শহর প্রান্তিকে। যার সোনালী রোদ্দুরে পিঠ পুড়িয়ে দুপুর ভাসানো যায় , ভোরের মিঠে রোদের ঠান্ডায় ভিজে ওঠে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন আর যার উষ্ণতা মেখে হেঁটে আসা যায় কোপাইয়ের ধার, ক্যানালের পাড় । খোয়াই হাটের অস্তরাগের শীতল গোধূলিতে  নক্সীকাঁথা যেখানে কথা হয়ে ওঠে আর গোয়ালপাড়ার ভোর হয় খেজুররসের হাঁড়িতে । শ্যামবাটির বাজার সকাল ঝলমলে হয় বিকিকিনিতে । সরগরম হয়ে ওঠে চিতল-পাবদা-পার্শ্বে আর সুরুল-পুকুরের চিংড়িতে । ভুবনডাঙা সবুজ হয়ে যায় চাষীদের পসরায় । পৌষমেলায় যায় আমবাঙালী। আমি যাই নিরিবিলিতে। আর গ্রামের মেঠো পথের গন্ধ নিতে । ঘর থেকে দু-পা ফেলে কত কিছু বাকী এখনো সেই ভেবে মরে যাই ।


গতকাল গেছিলাম প্রান্তিক থেকে বেরিয়ে ইলামবাজার, পানাগড়, দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জ, আসানসোল, ডিসেরগড় হয়ে দামোদর পেরিয়ে নেতুরিয়া ব্লকে ঢুকে পাঞ্চেত পাহাড়ের গায়ে গড়পঞ্চকোট । ভোরের গোলাপী কুয়াশা দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ইলামবাজারের সোনাঝুরি এভিনিউর মধ্যে দিয়ে । ১২১ কিমি চলার পর সরবড়ি মোড় এল । সেখান থেকে বাঁকামোড়, জুলিমার্গ, তিলতোড় আর সামনেই পাঞ্চেত জলাধার । পুরুলিয়া জেলার মধ্যে তখন রঘুনাথপুর বনাঞ্চলে বনবিভাগ দফতরের  ইকোট্যুরিজম সেন্টারের মধ্যে পুছতাছ করা হল গড়পঞ্চকোট নিয়ে । সরকারী সাহায্য পাওয়া তো দূরের কথা তাঁরা বেশ ধান্দা করলেন কিভাবে গাড়ি প্রবেশ করিয়ে পয়সা আদায় করা যায় । অগত্যা হাঁটা দেওয়া উল্টোপথে । বনের মধ্য দিয়ে অরণ্য অভিযান করতে করতে । দারিদ্র্য লুটেপুটে খাচ্ছে অরণ্য । বাঘমারা জুনিয়ার হাইস্কুলের পর গোবাগ মোড় পড়ল । বিশাল এক পুকুরের পাশ দিয়ে দেখা গেল গড়পঞ্চকোট হাইস্কুলের পাঁচিল । সেই রাস্তা ধরেই গেলাম স্থানীয় মানুষকে জিগেস করতে করতে গড় দেখতে । গ্রামের মেঠো পথ। দুধারে মরাই ভরা ধান উঠেছে সবেমাত্র। আর গোয়াল ভরা গরুও আছে তাদের কিন্তু তবুও দারিদ্র্য, এখনো দারিদ্র্য । আজ তাদের পৌষপার্বণ হবার কথা। নবান্নে মুখরিত হবার কথা । কিন্তু স্থানকালপাত্রভেদে বাংলা আজো এমনটাই রয়ে গেল ! ২০১৩'র শেষদিনে ওদের জন্য একটু প্রার্থনা করলাম মনে মনে । 

 দারুণ অভিজ্ঞতা হল । পাহাড়ের ওপর প্রায় ঘন্টাখানেক ট্রেকিং হল। ইংরেজরা বলত পানচেট। সেই থেকে পাঁচেট বা আমাদের পাঞ্চেত। তবে এই নামের উত্সমূলে পঞ্চকোট পাহাড়। পুরাণের শেখর পর্বত। পাহাড়টির পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট বলে এই নাম। নিঃসন্দেহে শীতভ্রমণের জন্য আদর্শ শাল-মহুয়া-পলাশ-আকাশমণির জঙ্গল পরিবেষ্টিত এই অঞ্চল। পঞ্চকোট বংশের প্রতিষ্ঠাতা দামোদর শেখর। রাজারা এসেছিলেন সুদূর পশ্চিমের মাউন্ট আবু থেকে। এরা ছিলেন প্রখরবংশীয়। এই রাজবংশের এক রাজা কল্যাণ শেখর নাকি বাংলার রাজা বল্লান সেনের কন্যা সাধনাকে বিয়ে করে যৌতুকস্বরূপ পান সেনবংশের কুলদেবী শ্যামরূপা। এই দেবী‌ই নাকি কল্যানেশ্বরী। পাঞ্চেত পাহাড়ের কাছেই এই কল্যাণেশ্বরীর মন্দিরটি। গড়পঞ্চকোট এলাকার সব মন্দির কালাপাহাড়ের অত্যাচারে ধ্বংস হয়।  পাহাড়ের মাথায় নদীর ঝোরা আর অতি প্রাচীন রঘুনাথজীর  মন্দির । আর নীচে  প্রবেশদ্বার, রাজার প্রাসাদ, রাণীদের মহল, আরো মন্দির...সব মিলিয়ে যার নাম গড়পঞ্চকোট । জুতো খুলে এখনো ভগ্ন মন্দিরে মানুষ পা রাখে । পাথরের মন্দির । প্রবেশদ্বারেই দুয়ারবাঁধ তোরণ, পোড়াইঁটের পঞ্চরত্ন মন্দির রাসমন্দির, রাণিমহল সবকিছুই ছিল  একসময়। তবে এখন বেশীটাই ধ্বংসাবশেষ।  মধ্যে লক্ষ্মী নারায়ণের খোদাই করা পায়ের ছাপ আর মূল মন্দিরে যেখানে আগে রঘুনাথ অর্থাত রামচন্দ্রের বিগ্রহ ছিল সেখানে চামচিকের আবর্জনাময় । কিন্তু মন্দিরের ভেতরে মাথার দিকে তাকালে অবশিষ্ট কারুকার্য এখনো লক্ষ্য করা যায় । দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের মাথায় ওয়াচ টাওয়ার । দুই ভাই শেখরচন্দ্র আর আখরচন্দ্র ছিলেন এখানকার রাজা । সম্ভবতঃ বর্গি আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে গড়পঞ্চকোট ও সন্নিহিত মন্দিরগুলি । দুটি গ্রামের ছেলে হল আমাদের গাইড। ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের এমাথা থেকে ওমাথা সব দেখালো। তন্ময় কৈবর্ত আর রামু বাউরী দুই বন্ধু । প্রথম জন স্কুলে যায় । অন্যজন যায়না। মাঠে গরু চরায় । ট্যুরিষ্ট সিজনে ওরা গাইডগিরি করে । তন্ময়ের শখ বড় হয়ে পড়াশুনো করে গাইড হবার । আর রামুর শখ দেবের মত হিরো হবার । দেবের সব সিনেমা তার ঠোঁটস্থ । দারুণ হেল্পফুল ছেলেদুটো ।  আমার বছর শেষ হল ওদের মঙ্গলকামনা করে। 


আজ বছরের শেষদিনে গেলাম আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতির গ্রাম কীর্ণাহারে । অদূরেই চন্ডীদাসের বাসভূমিখ্যাত নানুর গ্রাম  । প্রান্তিক থেকে মাত্র ঘন্টাখানেকের রাস্তা । কীর্ণাহারে রাস্তার ওপর "ফাইকাস" নামে এক ইকো রেসর্টে বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে লস্যি খাওয়া হল । এদের নিজস্ব ডেয়ারীর দুধের দৈ থেকে তৈরী লস্যিটি অতীব সুস্বাদু । বিশাল পুকুর সামনে। বক মাছ ধরে খাচ্ছে । বনের মধ্যে অসংখ্য ফলের গাছ, ফুলের গাছ। টাটকা সবজী কেনা হল । 


২৩ ডিসে, ২০১৩

বনভোজন ২০১৩


গ্রামের নাম হাজার ঘড়ি কুমোরপাড়া । দক্ষিণবাংলার নদীমাতৃক অঞ্চল। আরো কিছুটা এগুলেই সমুদ্রের নোনা জল আর বালিয়াড়ি দেখা যাবে । গ্রামবাংলা অনেকটাই শহুরে হয়েছে নগরায়নের দৌলতে। অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে । কিন্তু গ্রামবাংলার মানুষের সেই দারিদ্র, সেই অতিবৃষ্টির জন্য বানভাসি ঘর দুয়ার অথবা খরায় বৃষ্টির হাহাকারে ধান লাগাতে না পারার কষ্ট রয়েই গেল । যারা পরল তার মধ্যে থেকেই পালিয়ে গেল চেন্নাই অথবা হায়দ্রাবাদে কিম্বা ব্যাঙ্গালোরে , যা হোক একটা চাকরী নিয়ে আর যারা নিতান্ত‌ই সাদাসিধে, অল্পে সন্তুষ্ট তারা পড়েই থাকল বদ্বীপের ফাঁকে অধঃক্ষিপ্ত নাগরিক হয়ে । পঞ্চায়েত আপিসে হানা দিল। পার্টি আপিসে দৌড়ালো অথবা ভোটও দিল কথামত ঠিক সময়ে, সঠিক চিহ্নে । তবুও তাদের উত্তরণ হলনা । কাকভোরে আমরা বেরিয়েছিলাম হাজারঘড়ি গ্রামের উদ্দেশ্যে । রায়দীঘি পৌঁছলাম ঘন্টা চারেক পর । তারপর সেখান থেকে একাদশ শতাব্দীতে তৈরী অতি প্রাচীন একটি মন্দির দেখতে যাওয়া হল । 

জটার দেউল মন্দিরের নাম । স্বয়ংভূ শিব মন্দির । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দেখভালে  মন্দির ও তার আশপাশ বেশ সংরক্ষিত তবে তৃতীয় বিশ্বের চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকরা যথারীতি পর্যাপ্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক পূর্ণ করে ফেলেছে ঐ সুন্দর এবং নিরিবিলি স্থানটিকে ।  ঐ একটি কাজে আমরা খুব পটু। তা হল নিয়ম ভাঙা । সেখানে গার্বেজ ফেলার ব্যাবস্থা করে রেখেছে এ এস আই তবুও সংবরণ করা যায়না যত্রতত্র জঞ্জাল ফেলার অভ্যাসকে ।  মন্দিরের গায়ে পোড়া ইঁটের ওপর নিখুঁত স্থাপত্য ।  অনেকটাই সময়ের ভারে নষ্ট হয়ে গেছে । অভ্যন্তরে গর্ভগৃহের মধ্যে তাকালে দেখা যায় কত উঁচুতে দেওয়ালের গায়ে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর ব্যাবস্থা । 
ঐ গ্রামের বৌটি আমাদের জন্য লুচি আর আলুর দম বানিয়ে হাজির হয়েছিল রায়দীঘিতে  । তারপর গরম চা । সেখান থেকে আমরা গেলাম সেই গ্রামের আতিথেয়তার  স্বীকার হতে । পূর্ব পরিকল্পিত চড়ুইভাতি বা প্রকৃত অর্থে বনভোজনের মেজাজ নিয়ে । ধানজমির সরু আলের মধ্যে দিয়ে ডাইনে পান্নাপুকুরের সবুজ জলে ভাসমান গোলাপী শালুক আর বাঁয়ে গোলা ভরা ধান চলল সাথে ।  কোথাও হলুদ সর্ষে ক্ষেত কোথাও আলু, একফালি সবুজ কচি ধানগাছের পিছনে সয়াবিনের ক্ষেত অথবা ফুলকপি ।
বড় সুন্দর এই অনুভূতি। শহর থেকে গিয়ে শুধু সবুজে চোখ জুড়োনো যে কি ভালো লাগে! বারবার এই  মাটির রূপ দেখতে ইচ্ছে করে । দীঘিভরা জল করে টলমল।শীতকালে খেজুরগাছে হাঁড়িবাঁধার ধুম । আর স্নানের অছিলায় গ্রাম্য বধূর পুকুর সাঁতরে গামছা দিয়ে চিংড়ি-কাঁকড়া নিয়ে ভিজে কাপড়ে ঘরে ফেরা ।  

খনকার প্রজন্মের কাছে শীত-পিকনিক মানেই কেটারিংয়ে কব্জি ডোবানো, দুটো সাউন্ডবক্স থেকে জোরদার গানের সাথে উদ্দাম নৃত্য আর ইবিজা, কান্ট্রিক্লাব বা বেদিক ভিলেজের মত বিলাসবহুল আপ্যায়নে অবগাহন। এর থেকে অব্যাহতি পেতে গতকাল আমরা বনভোজনে গেলাম দক্ষিণবঙ্গের রায়দিঘীর কাছেই এক গ্রামে ।পালবংশের আমলে তৈরী অতি প্রাচীন মন্দির "জটার দেউল" দেখা একটি বিশেষ পাওয়া । 
 খাড়ির জল যত্রতত্র খেলে বেড়ায় সেগ্রামে ।   মাটীর নীচে কাঁকড়ার বাসা যেখানে আর ধানক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে দিয়ে হেঁটে আসা যায় সেখানে । কুড়োনো যায় নোনাবালির মধ্যে থেকে ঝিনুক আর শামুকের খোলা । সুন্দরী আর গরাণ গাছও আছে কিছু । কচি কচি টোপা কুল ধরেছে গাছে । কচি নারকেল পাড়িয়ে তেষ্টা মেটানো।খেজুর গাছে হাঁড়ি এখনো বাঁধেনি তারা । ঠান্ডা নেই । কুয়াশা নেই তাই । বড় বড় কাঁকড়া ধরানো হল গর্তর মধ্যে থেকে । দাম পেয়ে গ্রামের মানুষ ও বেজায় খুশী । আমাদের ভ্রমণের সাথে সাথে গরম ভাত মাটির উনুনে ফুটতে লাগল । আমরা পৌঁছতেই মাটির ঘরের দালানে রেডি দুপুরের আহার ।গরম ভাত, ডালের সাথে নদী থেকে সদ্য ধরা চুনোমাছ ভাজা , ক্ষেতের টাটকা শাকসব্জীর চচ্চড়ি, দিশী মুরগীর ঝোল  আর টমেটোর চাটনী । 
  তেলা মাথায় তেল না দিয়ে তোমরাও ভেবে দেখতে পারো গ্রামের মানুষদের সাথে কি করে কিছুক্ষণ কাটিয়ে মাটির গন্ধ নিয়ে আসা যায় । প্রকৃত অর্থে চড়ুইভাতি হল কাল । মাটির উনুনে রান্নাবান্না আর টিউকলের জলে আঁচানো সব মিলিয়ে আমি ও আমার সর্বক্ষণের ওঠাবসার সাথীরা বেজায় খুশি । আর অতিথি আপ্যায়নে গ্রামের মানুষের কোনো খামতি নেই । ফেরার পথে তাদেরি বাড়ির একজন প্রত্যেকের হাতে একঠোঙা করে মুড়ি, আলুর চপ আর বেগুনী দিয়ে দিল গরম গরম । ওরাও খুশি একটু বিক্রিবাটরাও আর আমরাও খুশী প্রাকৃতিক বনভোজন সেরে । 


Truly your's হয়েই থাকলাম পশ্চিমবাংলা।
তোমার সবুজে সবুজ আর নীলিমায় নীল দিগন্তে আমি মোহিত আবারো । আক্ষেপ কেবল একটাই.. শুধু চাই ভালো ও চওড়া রাস্তা যাতে শহর থেকে গ্রামের মানুষগুলো সহজেই আসা-যাওয়া করতে পারে আর চাই একটু শিল্প । গ্রামবাংলার যা আছে তা অনেকের কাছে ঈর্ষার । শুধু চাই দক্ষ পরিচালনা  আর পরিকাঠামো । চাষের জমি থাকুক । পাশাপাশি ফ্যাক্টরি  হোক দু-চারটে ।  ঐ মানুষগুলোর কর্মসংস্থান হোক  ! শুধু চাষ করে আর মাছ ধরে ওদের দুবেলা পেটটা হয়ত ভরে কিন্তু কুঁজোরও তো চিত হয়ে শুতে ইচ্ছে হয় !

১৯ ডিসে, ২০১৩

৪ ডজন বছর দেখলাম!


বিধাতা বললেন... বলি মেঘে মেঘে বেলা হল না ! কচি খুকীটি হয়েই থাকবি না কি ? ৪ যুগ হল এয়েচিস মুখপুড়ি এই পৃথিবীতে ।
মেয়েটি বলল... ঠিক বলেছ, অনেক হল । কিন্তু গাইব কত, লিখব কত ... তবুও তো মোটে ১২ গন্ডা। তোমার কি আসে যায় তাতে ?
বিধাতা ক‌ইলেন... আবার বলে মোটে!
মেয়েটি বললে... ৪ ডজন তো মাত্র হল, তাতেই মুড়োই নটে ?
বিধাতা ক‌ইলেন... ২ কুড়ি আর ১/২ কুড়ি থেকে ২ কম, তাতেও মেয়ের ফুরোয় না দম!
মেয়েটি বললে... রোশো বাপু ! ক‌ইমাছের জান! সহজে যাবেনা প্রাণ.. সেঞ্চুরী করি আগে, (২০x+১০) - ২ তো বড্ড কম কম !

*********************************
 আজ আমার মনে হল এই হেঁয়ালি করেই শুরু করি আজকের প্রিয় দিনটি । কিছুটা অংকের ধাঁধায় কিছুটা বয়স না ভাঁড়িয়ে সত্যচারণ করে ।দেখতে দেখতে কেটে গেল কতগুলো বছর। ভালোলাগায় মন্দলাগায়, ভালোবাসায়-মন্দবাসায় ...
আমি তখন ঘুমবিছানায় মায়ের কোলে আলো
পাড়ার লোকে বলেছিল পেত্থম মেয়ে হল?
মা বলেছিল  তা কেন? আমার প্রথম বন্ধু সে
আমার সারাক্ষণের ওঠাবসার একরত্তি মেয়ে ।  

আমি কেবল থোড়বড়ি আর জঞ্জালেরি ভীড়ে
কাজলাদিদির পায়ের নূপুর, কমলালেবুর শীতের দুপুর
বর্ষাদিনের কাজরীগান, মায়ের সাথে বিষ্টিস্নান
সবটা যেন ফুরিয়ে এল কেমন চুপিসাড়ে !  

***************************

১৯শে ডিসেম্বর সকাল সকাল ফেসবুকের ইনবক্সে উড়ে আসা একরাশ জন্মদিনের শুভেচ্ছা মনে করিয়ে দেয় আজকের দিনটার কথা । আজ আবার ৪র্থ বাংলা ব্লগ দিবস ও । এতটা বছর পার করতে করতে এই দিনটাতে নানারকমের অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে নিলাম আঁচল ভরে ।
একবার ছোটবেলায় বাবা হাতে তুলে দিয়েছিলেন  "ছোটদের বুক অফ নলেজ" ।ব‌ইখানা আমার থেকে বড় ও ভারী ছিল তাই সে ব‌ই যখন হাতে করে পড়তে শিখলাম তখন আরো অনেকগুলো জন্মদিন পেরিয়ে গেছে ।

 ১৯৮৫ সাল  ; তখন বেথুন কলেজের থার্ড ইয়ার । পার্ট-টু পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে রয়েছি বাড়িতে ।  রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায় । গান শিখতে গেছি ঐ দিন বিকেলে । বাড়ি ফিরে দেখি একপাল বন্ধুরা বাড়ীতে অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টি দিতে হাজির । আমার কুড়ি বছর পূর্ণ হওয়ায় একুশটা রসোমালাই ভর্তি হাঁড়ি আর একুশটা হলদে গোলাপ নিয়ে সেদিনের সন্ধ্যেবেলায় আমার বাড়ির ড্র‌ইংরুম জমজমাট হল । বিয়ের ঠিক হল ১৯৮৮ সালে । পৃথ্বীশ তখন ডালাসে পিএইচডি স্টুডেন্ট । জন্মদিনের প্রথম লাভলেটার এল নীলখামে বন্দী হয়ে বিদেশ থেকে । সাথে গ্রিটিংস কার্ড ও একটা ছোট্ট উপহারের বাক্সে ছোট্ট ছোট্ট রকমারি পারফিউমের  সুদৃশ্য বোতল ।   সে এক অনুভূতি । জীবনের প্রথম প্রেমিক বন্ধু, হবু স্বামীর কাছ থেকে উপহার ! আবিষ্কার করেছিলাম নতুন করে নিজেকে । আবিষ্ট হয়েছিলাম অন্য রকম এক ভালোলাগায় । এরপর বিয়ে । তারপর ছেলে ও একে একে সংসারের ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া ।
বিয়ের পর জন্মদিনের কোনো সুখস্মৃতি আমার মনের কোণায় থিতিয়ে পড়ে নেই । আমি কে, আমি কেন আর আমি কি জন্যে জন্মে এই বাড়িটায় এসে হাজির হয়েছিলাম বিয়ের পরে প্রথম কয়েক বছর তা আমাকে কেবলি তাড়া করে বেড়াত । সে সময় চাইলেও আমাকে ওর মত করে পেত না আর আমাকে ওর ইচ্ছেমত ভরিয়েও দিতে পারত না । আমার জন্য কিছু নিয়ে আসা মানেই বাড়িতে তুফানি ঝড় বয়ে যেত আর আমাকে ঘিরে এক অশান্তির বাতাবরণ তৈরী হয়ে যেত নিমেষের মধ্যে । তাই ভুলে যেতে বাধ্য হতাম ঐ বিশেষ দিনটাকে । একবারের ঘটনা খুব মনে পড়ে । আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে  জেমস বন্ডের সিনেমা "টুমরো নেভার ডাইসের" নাইট শোয়ের টিকিট কাটিয়ে রেখেছিল আমাদের ড্রাইভারকে দিয়ে । রাতে বাড়ি এসে ডিনার খেয়ে আমাকে তৈরী হয়ে নিতে বলল " প্রিয়ায় টিকিট কাটা আছে, এই বলে "  চলেও গেলাম অপ্রত্যাশিত একরাশ আনন্দ সঙ্গে করে । রাতে বাড়ি ফিরে দরজা খুলে দিতে হল বলে মুখ ভার দেখলাম তাঁর আর পরদিন চায়ের টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করে র‌ইল সেই কাল মাঝরাতে না বলা বকুনির কথা । " বৌ কে নিয়ে আদিখ্যেতা !!! যত্তসব ! " ভুলে গেলাম জন্মদিনের স্মৃতি ।  এভাবেই পেরিয়ে গেছে বাইশটা বছর এই বাড়িটায় । কিন্তু আমার জন্যে মায়ের মত পায়েস রেঁধে বা ছোট্ট কোনো উপহার নিয়ে কখনো সারপ্রাইস দেয়নি জন্মদিন; যে মানুষটা ভালোবেসে কিছু দিতে চেয়েছে আমাকে তার জন্য তাকে শুনতে হয়েছে অনেক কিছু, স‌ইতে হয়েছে শতেক । কারণ আমি যে অন্য বাড়ির মেয়ে তাদের বাড়ির উত্তরসুরীর জন্মদাত্রী! আজ তারিখটা এলেই মনে পড়ে সেই সব দুঃখের স্মৃতিগুলো । শিউরে উঠি আর বলি,  জন্মদিন, তুমি অন্যের হও, কিন্তু এসো না তুমি আমার হয়ে ।
 ২০১০ এ ভাইয়ের বাড়িতে  পুণায় ছিলাম এইদিনটিতে ।   আগের দিন  দুপুরের খাওয়াদাওয়া, যত্নাআত্তির কোনো ত্রুটি ছিলনা । বিকেল হল । সন্ধ্যে হল । আমরা হৈ হৈ করে বেরুলাম.. মন্দিরে গেলাম । ক্রসওয়ার্ড এ গেলাম । সেখান থেকে পিতজা হাট । খুব খাওয়া হল ।  ফেরার পথে গ্রিন আপেলের ভদকা হল সঙ্গের সাথী । ফিরে এসে রাত বারোটা ছুঁইছুঁই । আমার জন্মদিনের ঘন্টা বাজবে এই বুঝি । টলোমলো পায়ে সে এল গিফট হাতে  ।  ভাইয়ের ছেলে গুগ্‌লের কাছ থেকে "হ্যাপি বার্থ ডে পিসিমণি ( খুতুন)" শুনে আমার ভরে গেছিল মন ।   এত আনন্দ বুঝি কোনো জন্মদিনে হয় নি আমার !
 গতবছর ২০১১ তে জন্মদিন পালন হয়েছিল ট্রেনের মধ্যে । আমরা অমরকন্টক যাচ্ছিলাম । সেও এক অন্যরকমের অনুভূতি ।   এবছর ২০১২ তে আমার ছেলে তার পকেটমানি দিয়ে  আমার জন্য একটা কাঠের কাজ করা সুন্দর রাজস্থানী মশাল এনেছে । ও জানে মা ঘর সাজাতে ভালোবাসে । তাই এই সারপ্রাইজ । প্রতিবছর আমার জন্মদিন আসতে না আসতেই ৩৬৫দিনের পুরোণো একটা বছরের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবার তোড়জোড় ।

জীবনের আলপথগুলো গুলো চলতে চলতে অনেক বন্ধু এল চারপাশে । একঘেয়েমি কাটল ফেসবুকের একচিলতে ব্যালকনিতে । কেউ ভালোবেসে ছুঁড়ে দিল একরাশ জুঁইভেজা বৃষ্টিকবিতা । কেউ দিল একগোছা শুকনো রজনীগন্ধা । কেউ আবার শিশিরসিক্ত শিউলির গন্ধ নিয়ে সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। আলতো করে ধরে আছি বন্ধুত্বের হাত । ভয় হয়, পাছে দুঃখ পেয়ে বসি । আলগোছে পছন্দ করি বন্ধুর ছবি ।  ভয় হয়, যদি আঘাত পাই।  বন্ধুকে প্রতিদানে হয়ত ফিরিয়েও দি একমুঠো সত্যি শিউলি কিম্বা জুঁইভেজা সন্ধ্যেটা ।

চলতে থাকে জীবন। আলগোছে, আলতো পায়ে । মনের কার্ণিশ বেয়ে নিঃশব্দে উঁকি দেয়  এসেমেস। বেজে ওঠে মুঠোফোন ঝন্‌ঝন্‌ । আমার মনোবীণায় সে ঝঙ্কারে হয়ত সামিল হয় অচেনা কোনো পাখি । সে শুধু বলে তুমি একা নও ।  ইনবক্সে উড়ে আসে অচেনা মেল, হঠাত মেল ।
চলতেই থাকে জীবন ছেঁড়া ছেঁড়া কবিতার ঘ্রাণ নিয়ে, অলস সময় পেরিয়ে যায় বৃষ্টিপথ, ভাবনার গদ্যেরা ভেসে যায় আপন খেয়ালিপথে, আলগোছে, আলতো পায়ে...

কখনো খেয়ালপোকা কিলবিল করে ওঠে । বলে "চল্‌, কোথাও ঘুরে আসি"
কখনো টেষ্টবাড গুলো লক্‌লক্‌ করে ওঠে "বলে চল্‌ ! ভালো কিছু খাই"
এদের নিয়েই  আমার ভালোমন্দ । এদের সাথে ওঠাবসা ।  আর রয়ে গেলে তোমরা । পুরোণো সেই আমির সাথে । চেনা চেনা রোদ্দুরে, অচেনা রাস্তায়, ভালোবাসার ফুটপাথে.......
একমুঠো কুচোনো কবিতার কলি দিয়ে জীবনপাত্রটি ভরে চলেছি । দুফোঁটা গান নিয়েছি সাথে। তিন-চার চামচ বৃষ্টি আর ছড়ানো ছেটানো শিশির ফেলেছি সেই জীবনপাত্রে । কথামালার টুকরো আখরগুলো দিয়ে  উথলে উঠি উঠি পূর্ণপাত্র । সবশেষে গার্ণিশ করলাম ভালোলাগার ঝর্ণাকলমের ফোঁটা দিয়ে । আর ভালোবাসার ঢাকনি দিয়ে বন্ধ করলাম আজকের রেসিপি ।
ভাগ্যি ব্লগ লিখতে শুরু করেছিলাম । তাই আজকের এই বিশেষ দিনে মন খুলে কটা কথা লিখতে পেরে ধন্য হলাম । এটাই এবারের  জন্মদিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া !
 

৭ ডিসে, ২০১৩

ডালাস ডায়েরী : পর্ব ১

-->


সালটা ছিল ১৯৮৯ । মার্চ মাস ।
সুদূর ডালাসে পাড়ি দেওয়া হল । আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমের টেক্সাস স্টেটে অবস্থিত ডালাস । বহু প্রতীক্ষিত বায়ুপথে ভ্রমণ..
বিমানবন্দর থেকে একে একে চোখের বাইরে চলে গেল মা, বাবা আর ভাইয়ের ছলছল চোখ ।
জীবনে প্রথম বায়ুপথে হারিয়ে যাওয়া । দমদম থেকে দিল্লী । সেখানে বন্ধুবান্ধবের সাথে গেটটুগেদার । মধ্যরাতে দিল্লী এয়ারপোর্টে গিয়ে আবার উড়ানে জার্মানি । সেখান থেকে আরো দূরে আটল্যান্টা ।
এয়ারপোর্টে ফ্রেস হয়ে বিধ্বস্ত জামাকাপড় বদল করে ছোট্ট এক ফ্লাইটে আটল্যান্টা থেকে সোজা ডালাস পৌঁছালাম বিকেলবেলায় । ইউটিডালাসের ম্যনেজমেন্ট স্কুলের পিএইচডি স্টুডেন্টরা সব এসেছে.. একপাল অপরিচিত মুখ সাদরে অভ্যর্থনা করল ডালাস এয়ারপোর্টে । ভারতীয় স্টুডেন্টদের একাধিক গরীব রথ বরণ করে ঘরে তুলছে আমাকে ... সে এক অভিনব অভিজ্ঞতা ।
অবশেষে পৌঁছলাম ডালাস ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামের এপার্টমেন্টে । ঘুমে তখন দুচোখ বুঁজে আসছে । অথচ বন্ধুদের হল্লা আর হুল্লোড়ের খামতি নেই । গরম ভাত থেকে শুরু করে পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে রেখেছে বাঙালী বন্ধু পত্নী । আমি তখন জেটল্যাগ সর্বস্ব । তবুও হাসিমুখে আলাপ পর্ব সেরে চলতে হল সকলের সাথে ।


আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েই মনে হল ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য এই দেশ, কত সুন্দর সৌজন্যবোধ মানুষের, সুন্দরের সত্য পূজারী তারা,
তারা কত রুচিশীল, সত্যিই তারা গড়তে জানে নিজেদের আর ভালবাসে তাদের দেশকে, রক্ষা করতে পারে ভগবানের সৃষ্টিকে, আর নিজেদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে, উজাড় করে দিতে পারে বিশ্বের দরবারে;
তুমি বলবে কৃত্রিমতা এ শতাব্দীর অভিশাপ কৃত্রিমতা যদি উন্নতি ঘটায় তাহলে বাধা কোথায়? বিজ্ঞান যদি কাজের বন্ধু হয় তাহলে আপত্তি কিসে ? সৃষ্টিসুখের উল্লাসে আমরা বাঁচিনা একটু সহজ করে, সাবলীল ভাবে!
আসলে যে দেশের নাগরিকের চিন্তাধারা সুস্থ, যারা সভ্যতায় পরিপুষ্ট, বিধাতাপুরুষ বোধ হয় দুহাত তুলে তাদের আশীর্বাদ করেন..
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্যে, প্রাকৃতিক জলবায়ুর মিষ্টতায় সে দেশের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রোজ আমরা প্রণাম জানাতাম নিজের দেশমাতৃকাকে ।

এর মধ্যে দেশের মানুষগুলোর জন্য মন কেমন করলেই চিঠি লিখছি ফাঁকে ফাঁকে । তবে বেড়ানোর আনন্দে দখিনের খোলা জানলায় সব ওলটপালট । ফাগুণের ওমে শীত লুকোল শুকনোপাতায় । পলাশের হাসিতে শীত-ফুলেরা মুখ ঢেকেছে চুপিসাড়ে । শিমূল, অশোকের হট্টমেলায় ডালেডালে কাঁচা সবুজের ছোঁয়া । মাতাল বসন্তে রঙীন প্রকৃতি ।

ভোরবেলা কিচেনের ব্লাইন্ডস সরিয়ে ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামসের পার্কিং লটে তাকিয়ে থাকা সার সার গাড়ির ছাদে দুধসাদা বরফের চাদর ..তার সাথে সূর্যের আলোর মাখামাখি !
দুপুরবেলা বান্ধবীদের সাথে শপিংমলের হাতেখড়ি, একরাশ বিদেশী পারফিউমের গন্ধ নিয়ে ফিরে আসা, বিকেল হলেই নতুন জলখাবার তৈরী আর প্রতীক্ষা...
তারপর রোজ চোখ রেখেছি অপার বিস্ময়ে, কখনো ডালাস ডোমের মাথায় গরম কফি হাতে, টেক্সাস ও ওকলাহোমার বর্ডারে অসাধারণ টেক্সোমা লেকের জলের ধারে । কখনো টাইলার রোজ গার্ডেনের গোলক ধাঁধায়, কখনো নেচে উঠেছে প্রাণ টার্নার ঝোরার ধারে, গুহার ভেতর .. গেয়ে উঠেছে মুক্তির আনন্দে, নেচে উঠেছে ঝোরার জলের ছন্দে... 

এল বি জে এক্সপ্রেস ওয়ের ওপর দিয়ে লং ড্রাইভে ছুটেছি কত কত বার আমার স্টুডেন্ট স্বামীর সেকেন্ডহ্যান্ড দুধসাদা মাজদা ৬২৬ গাড়িতে, হৈ হৈ করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উইকএন্ডট্রিপ !হঠাত প্ল্যান করেই "চলো লেটস গো" বলে বেরিয়ে পড়া আর কি !
প্রতি সপ্তাহান্তে এমন ছোটখাটো বেড়ানোর সাথে ছিল ভারতীয় বন্ধুমহলের কারোর একজনের বাড়িতে আয়োজিত পটলাক পার্টি । দারুণ আইডিয়া । বিদেশে এসে শিখেছিলাম । যার বাড়িতে পার্টি হবে সে ভাত/রুটি বানানোর দায়িত্বে থাকবে আর অন্যেরা যে যার ইচ্ছেমত ডিশ বানিয়ে আনবে । কেউ আবার পেপারপ্লেট, চামচ আর কোল্ডড্রিংক্সয়ের ভার নিত । দারুণ মজা হত এমন পার্টিতে । একঘেয়ে মেনু নয় কিন্তু পট লাক (potluck) অর্থাত কোন্‌ পটেতে কি আছে সেটা খাবার সময় খুলে দেখবার । আর সবচেয়ে বড় কথা হল যিনি পার্টির জন্য বাড়িতে সকলকে ডেকেছেন তাঁর ওপর অযথা চাপও পড়লনা ।

ডালাসে যেখানে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অবস্থিত তার নাম রিচার্ডসন । যেন শহুরে গ্রামের মাদকতা সেই অঞ্চলে 

University of Texas @ Dallas
রথযাত্রা দেখেছিলাম ডালাসে । ডালাস থেকে অনেকটা দূরে ইস্কনের কালাচাঁদজীর মন্দিরে রথের রশি টেনে কিছুটা স্বদেশের জন্য ব্যাকুলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম ।লুচি আর পাঁচমেশালী একটি তরকারী সহযোগে ভোগপ্রসাদও পেয়েছিলাম।

এরপর মনে পড়ে ৪ঠা জুলাইয়ের সেই লঙ উইকএন্ডের কথা । আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস । ডালাসের সাবার্বে একটি খোলা মাঠের ওপর বিকেল থেকে জমায়েত হল কয়েক হাজার মানুষ । তারপর সন্ধ্যের ঝুলে একে একে আকাশে ফুটে উঠতে লাগল রঙ বেরঙের ফায়ারওয়ার্কস । আতস বাজি, আলোর বাজি এত সুন্দর ভাবে পরিবেশন আর কোথাও দেখিনি । ব্যাবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি নেই । সুষ্ঠুভাবে প্রায় তিন চার ঘন্টা বাজি পোড়ানো হল সেই মাঠের ওপর । কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ল না । অথচ বৈচিত্র্যময়তায় ভরা সেই দীপাবলীর রাত যেন আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল । ফায়ারওয়ারক্স দেখে সে রাতের প্রোগ্রাম ছিল দল বেঁধে সকলে মিলে পিত্জা হাটে পিত্জা খেতে যাওয়া । তখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেনি পিত্জা হাট । তাই আমি অপার বিস্ময়ে গোগ্রাসে গিলেছিলাম সেই লোভনীয় ইটালিয়ান খাদ্য । তবে ভারতবর্ষের পিত্জা হাট কিন্তু চিজ ছড়ানোর ব্যাপারে আমেরিকার পিত্জা হাটের মত এখনো অত জেনারাস হতে পারেনি সেটাই বড় দুঃখ আমার । ঠাটবাট সব ঠিকই র‌ইল কিন্তু কোয়ালিটি একটু নিকৃষ্ট হয়ে গেল ।

সে ফাগুনের এক ভোরে আমরা প্ল্যান করে বায়ুপথে পাড়ি দিলাম ডালাস থেকে নিউইয়র্ক । আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নামে জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে অবতরণ হল । কি ঝকঝকে এয়ারপোর্ট আর কেমন সুন্দর সব ব্যবস্থা । এখানে সব কিছুর মেন্টেন্যান্স দেখলে অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকতে হয় । এমনটিই থাকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ।
নিউইয়র্কে এক বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আস্তানা বেঁধে সারাটাদিনের জন্য যাওয়া হল ওয়াশিংটন ডিসি ।
একটা গাড়ি নিয়ে রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথে.. অর্থাত যা কিনা বর্তমান রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার অফিস । ১৯৮৯ এ সেই সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন জর্জ বুশ । হোয়াইট হাউস বা প্রেসিডেন্টের অফিসকে এখানে ক্যাপিটল বলে ( capitol)

ডিসির রাজপথ হোয়াইট হাউসের রাজকীয় শুভ্রতায় কি অসাধারণ শন্তিময়তা, বাইরের সবুজ লনে কি সুন্দর সজীবতা সাথে গেরুয়া মরশুমি ফুলের একরাশ উচ্ছ্বাস দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম ।
এই তিন রঙ মনে করিয়ে দিল আমার ধন্যধান্যপুষ্পে ভরা নিজের দেশের কথা । মনে মনে প্রনাম জানালাম ত্রিরঙা জাতীয় পতাকাকে।
ক্যাপিটল হিলের কাছে লিংকন মেমোরিয়াল চির শুভ্রতায় জ্বাজ্জল্যমান এব্রাহাম লিংকনের স্মৃতি নিয়ে । সেখান থেকে ন্যাশানাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে । সেই বহু বিতর্কিত এবং অভিশপ্ত হোপ ডায়মন্ড দেখে অবাক হতে হয় । ঘন নীল হীরে । কোনোদিনো দেখিনি এর আগে । 

ন্যাশানাল গ্যালারি অফ আর্ট থেকে এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়ামে ঝুলন্ত ছোট বড় কত কত উড়োজাহাজের মডেল, আর তার বিবর্তন ।
তার মধ্যে থেকেই উঠে এল স্মৃতির মণিকোঠা থেকে রাইট ব্রাদার্সের হাতে তৈরী প্রথম প্লেনের মডেল । ক্লাস নাইনের ফিসিক্স ব‌ইয়ের সেই ছবি আজ ত্রিমাত্রিক মডেল হয়ে ঝুলছে চোখের সামনে..অরিভিল এবং উইলবার রাইট এই দুই ভাই সর্বপ্রথম আকাশের বুকে হাওয়া কাটিয়ে ত্রিমাত্রিক এরোপ্লেনের মডেল তৈরী করেছিলেন । মনে মনে ভাবলাম সার্থক হয়েছে ওয়াশিংটন আসা ।

সাময়িক বাকরূদ্ধতা !
ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশানাল গ্যালারী অফ আর্ট এ এসে পৌঁছালাম । বহু প্রতিক্ষীত ভাবনালোকের রূপসাগর ..
ডুব দিলাম সেই রূপসাগরে..
ইম্প্রেশানিস্ট, স্যুরিয়ালিস্টিক সবরকমের পেন্টিংয়ের সাথে হাতেখড়ি হল ! বিদেশের নামী সব শিল্পীর দামী সব তৈলচিত্র ।
Matisse, Rennoir, Claude Monet, Van Gogh, Paul Gauginর গল্পে মাত হয়ে গেছিল আর্ট গ্যালারির প্রতিটি করিডোর !
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হোল Da Vinciর আর এক বিরল সৃষ্টি দেখে যা মোনালিসার থেকে কোন অংশে কম নয় ।মোনালিসার হাসি নেই তাতে কিন্তু সেই ভয় মিশ্রিত গাম্ভীর্য্য..
অনবদ্য লাগল সেই আর্ট গ্যালারী পরিদর্শন । আরো চোখ জুড়িয়ে গেল ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেখে ।
বিদায়ের সময় মনে মনে বলে উঠলাম, বিদায় ওয়াশিংটন!
ডিসি তুমি দিগবসনা, সবুজ আঁচল শুভ্ররাজবেশে ছড়িয়ে দিয়েছো নীলের দিগন্তে , সৌন্দর্য তোমার অলংকার, রাজকীয়তা তোমার মজ্জাগত, নিয়ম শৃঙ্খলা তোমার সহজাত,
বেঁচে থাকো ডিসি তোমার অমলিন স্বর্গীয় রাজকীয়তা নিয়ে, আর সর্বকালের অহংকার নিয়ে । রাজধানী হবার যোগ্যতা তোমার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় । 

ছোটদের ই-পত্রিকা ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত   


২৪ অক্টো, ২০১৩

বিরিয়ানি, মুক্তো এবং পুজো


কোলকাতার ভীড়ভাট্টা ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পুজোটা কাটাবো এবার এই ঠিক ছিল  । ছেলের ফাইনাল ইয়ারের ইন্টার্নশিপ চলছে এখানে । সে ছুটি পাবেনা তাই আমাদের একসাথে পুজোর ছুটি কাটাতে যাওয়া । সকাল
থেকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকা তার জন্যে । কখন সন্ধ্যে হবে আর তার সাথে বেরুনো হবে । ভাবতে লাগলাম ছোট্টটির কথা । নাছোড় সেই বীরের কথা ।

তখন আমরা জামশেদপুরের বাসিন্দা । 
ওখানকার পুজোতে সেবার নবমীর দিন আগমনী গান গাইতে উঠেছি পুজোমঞ্চে, মাদুর্গার পাশে । নাম ঘোষণার পর স্টেজে উঠতেই  হৈ হৈ ।
আমার নাছোড় পুত্রের বাবা তাকে দর্শকাসনে বসানোর চেষ্টা করছেন আর সে মঞ্চে উঠবেই..
চারবছরের পুত্রটি ধীরে পায়ে এসে আমার পাশে টপ্‌ করে বসে পড়ল । আমি হতবাক!
অনুষ্ঠানের কতৃপক্ষদের সে বলল  মায়ের পাশে বসে রা'টিও কাটবেনা, তাকে বসতে অনুমতি দেওয়া হল ।
আমার  গান অবধি গম্ভীর হয়ে, হাতে ক্যাপবন্দুক নিয়ে  ঘটের মতন বসে র‌ইল চুপটি করে
মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় তাকে শুধালাম, এটা তুমি কি করলে? বাবার কাছে বসলেই পারতে..
সে বলল-  দুষ্টু অসুর যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে ! বীরপুরুষ আবৃত্তির সময় তুমিই তো বলেছিলে তোমার পাশে এমনি করে থাকতে!
আমি মনে মনে আওড়ে নিলাম "ভাগ্যি খোকা ছিল মায়ের সাথে" !
....

দিন কয়েকের মত শিকেয় তোলা র‌ইল মহানাগরিক কোলাহল । কিন্তু তেলেঙ্গানা পৃথকীকরণের জেরে আর ধেয়ে আসা ঘূর্ণাবর্তের আশঙ্কায় আহ্লাদে আটখানা হতে পারলাম না ।   একটু মনখারাপও হোল তবুও  ভালো লাগল ছুটির আনন্দে ।  ছুটি যেমনই হোক  আর পুজোর ছুটি  সব ছুটির থেকে অন্যরকমের । তবে খুব মিস করছিলাম  ঢাকের শব্দ ।  এবছর আশ্বিনের শারদপ্রাতে অকাল শ্রাবণের চোখরাঙানি এ শহরকেও তাড়া করে চলেছে । বৃষ্টি শরতের মুখে একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছে ।  মনখারাপের বাঁধ ভেঙে কবিতায় পেয়ে বসল আমায় । 


দুর্গা তোমার দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি কেন বলো ?
দুর্গা তোমার দৃষ্টি সুদূরে আঁধারে কিম্বা আলো ।
দুর্গা তোমার ঘামতেল আজ বিষণ্ণতার ছোঁয়া
ধুলোমুঠি শাড়ি মলিন আঁচল তবুও শিউলি ধোয়া ।
...

ছোটবেলায় ষষ্ঠীর ভোরে  মা'কে দেখতাম স্নান সেরে এসে প্রত্যেক দরজার মাথায় তেল-হলুদ-সিঁদুরের ফোঁটা দিতে । মা দুর্গাষষ্ঠীর ব্রতকথা পড়ে হাতে প্রসাদ দিতেন ।  সুদূরে বসে সেই স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই । সেই শুভসূচনার সাথে সাথে মায়ের আগমনের শুরু হয়ে যেত  । হোটেলের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাচ্চাদের স্কুল যাওয়ার তাড়া । অফিসকাছারি যাবার কর্মব্যস্ততা ।  কোলকাতার সাথে কোনো তুলনা নেই এ শহরের পুজোর । হোটেলের ব্রেকফাস্ট ব্যুফেতে গিয়ে নিরামিষ ফলাহার সেরে নিলাম ষষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে ।
রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো
 হোটেলের টেলিভিশনে ডিটিএইচ পরিষেবার মাধ্যমে আকাশবাণী কলকাতা পেয়ে দিব্যি খুশি হলাম । একে একে পুরোণোদিনের গান আর কলকাতার পুজোর আপডেট পেতে থাকলাম । প্যান্ডেল হপিং না করেই সেলেবদের খুচরো গসিপ আর বাংলা গান এর চেয়ে ভালো ছুটি কাটানো কিসে হতে পারে ? মাঝেমধ্যে ডিডিবাংলায় পুজো পরিক্রমা দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটালাম । আমার মনের ছুটির ঘন্টা আর ঢাকের বাদ্যি ততক্ষণে কোলকাতাকে এনে দিয়েছে চোখের সামনে । মায়ের আমন্ত্রণ, অধিবাস, বোধন চলছে ।
 সপ্তমীর শারদপ্রাতের সূচনায়  মনখারাপের মেঘ জমেছে । কলাবৌ স্নানের কোনো লক্ষণ নেই এ শহরে । হয়ত বা হচ্ছে তার প্রস্তুতি দূরে কোথাও , বহু দূরে । মনে পড়তে লাগল ঢাক, শাঁখের আওয়াজ.. ন'টি উদ্ভিদ চারা দিয়ে তৈরী কলা-বৌকে স্নান করিয়ে,  লাল পাড় সাদা শাড়ী পরিয়ে   মা দুর্গারূপে পুজো করা ।   
গোলকুন্ডা ফোর্ট

আমারা রয়েছি হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটির কাছে কোন্ডাপুরে । সেখান থেকে সপ্তমীর দিন গেলাম হুসেন সাগর নামে এক বিশাল লেকে । কি পরিচ্ছন্ন! 
 
হুসেন সাগরের বুদ্ধমূর্তি 

আর সেখানে ঐ বিশাল জলাশয়ের মধ্যে একটি অভিনব বুদ্ধমূর্তি দেখতে যাওয়া হল লঞ্চে করে । তারপর গোলকুন্ডা ফোর্ট ও চারমিনার ।
চারমিনার
 সপ্তমীর দিন আমাদের বাড়িতে খুব রান্নাবান্না হত ।   বিশেষ আমিষ পদ.. মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সেই  স্মৃতি নিয়ে পৌঁছে গেলাম   হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে পুরোণো রেস্তোঁরা প্যারাডাইসে । বিরিয়ানি   রায়তা ও কাবাব দিয়ে সপ্তমীর ভোজ সারা হল । সন্ধ্যের ঝুলে ডোমালগুডায় রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো দেখতে গেলাম । সন্ধ্যারতির পর পোহা প্রসাদ পেলাম । 
হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের দুর্গাপুজো
 এবার পাশেই ইন্দিরা পার্কের উল্টোদিকে  হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের ৭২বছরের পুরোণো পুজো দেখতে গেলাম ।  ওখানকার পুজোতে গিয়ে পুরোণো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা একটা বিরাট প্রাপ্তি ।   বাঙালী যেখানেই থাকুক ঠিক চেষ্টা করে যায় তার সাহিত্য-কলা-কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে ।বিরিয়ানি আর মুক্তার শহর  হায়দ্রাবাদও তার ব্যাতিক্রম নয় ।  সেখানেও এক আকাশের নীচে সব বাঙালী মানুষ  গান, নাচ, নাটকের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোকে পালন করছে । তবে এদের কোনো পুজোতেই কোলকাতার মত অনিয়ন্ত্রিত ভীড় নেই বা অহেতুক সেলিব্রিটি প্রদর্শনের হিড়িক নেই । আর নেই থিম পুজোর জাঁকজমক ।  কোলকাতার এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন। শুধু বেঁচে র‌ইল স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মহাষ্টমীতে সেরা পোষাকটি পরে অঞ্জলি দেওয়া । সারা বছরের মত মায়ের কাছে বাঙালীর যত কিছু চাওয়া  । "রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি"... ইত্যাদি আরো কত কিছু । 

মহাষ্টমীর ভোরে স্নান সেরে নিয়ে  হায়দ্রাবাদেও নতুন শাড়ি । তারপর আবার রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজোয় সামিল হলাম ।ঠিক বেলুড়মঠের মত একচালার হলুদ মূর্তি মা সহ তাঁর পরিবারের । মূল মন্দিরে  ঠাকুর রামকৃষ্ণ  টুকটুকে লাল দক্ষিণি পট্টবস্ত্রে, মা সারদা টুকটুকে লাল জরিপাড় মাহেশ্বরী শাড়িতে ও স্বামী বিবেকানন্দ গেরুয়া রঙের কাঞ্জিভরম ধুতিতে ।    চন্ডীপাঠের সকাল । মন্ত্রমুগ্ধ আবহ । স্তোত্রপাঠের পর  আরতি, পুষ্পাঞ্জলি ।  সবকিছুই বেলুড়মঠের রীতি অনুসারে । কিন্তু ভীড় কম বলে আরো যেন কাছে পাওয়া সেই দুর্গাপুজোকে । কোলকাতার পুজোতে যেন অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি বড্ড বেশি কৃত্রিম মনে হয় আজকাল । এরপর হোমযজ্ঞ । তারপর প্রসাদ বিতরণ । অভিনব ভোগপ্রসাদ । মাঠের ওপর পেতলের বিশাল হাঁড়িতে ঘিভাত বসেছে কাঠের জালে । আর সেই ঘিভাতের সাথে তেলুগু সবজী, চাটনী, পাঁপড়  ও মিষ্টি ডালপুরী । পরিতৃপ্তিতে ভরপুর মন ।  হোটেলে ফিরে এসে ডিডিবাংলায় সরাসরি বেলুড়মঠের সন্ধিপুজো দেখতে পেয়ে গেলাম ।
মনখারাপ হল তীব্র গতিতে ছুটে আসা ঘূর্ণিঝড়  পিলিন এর কথা শুনে । অন্ধ্র ও উড়িষ্যার উপকূলে ধেয়ে আসছে সেই ঘূর্ণাবর্ত । সে রাতে  অজানা আশঙ্কায় ঘুম এলনা দুচোখে ।
 বৃষ্টি কোলকাতাকে পুজোতে মুক্তি দেয়নি  কিন্তু শরতের আকাশের অনেকটা নীল দাক্ষিণাত্য মালভূমির এই শহরে  ধরা দিল । পিলিন অষ্টমীর রাতে ঊড়িষ্যার উপকূলে আছাড়ে পড়েছে এর‌ই মধ্যে । ততক্ষণে পিলিন শান্ত হয়েছে   অন্ধ্রে  । তবে ঊড়িষ্যায় বিপুল ক্ষতি করেছে ।  
সালার জাং মিউজিয়ামের বিখ্যাত ভেলড রেবেকা 
 নবমীর সকালে এ শহরের আরো এক মুখ্য আকর্ষণ সালার-জাং মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে থকে যাওয়া আর নবমীনিশিতে আবার মন উচাটন কোলকাতার ধুনুচিনাচের জন্য । আর সেই সোনার প্রতিমা ভাসানের সুর যেন বেজে উঠল কানে কানে ।

 মনে মনে গেয়ে উঠলাম " নবমীনিশি রে তোর দয়া নাই! এত করে সাধিলাম ..."

নবমীর দুপুরে মাংস খাওয়ার রেওয়াজ সব বাঙালী বাড়িতে । কাবাব-বিরিয়ানি-তন্দুরীর শহরে তার জন্য হাপিত্যেশ নেই । অলিগলিতে মুখরোচক দোকান । ঐদিন এ শহরে নবরাত্রির সাজগোজ যেন একটু বেশিমাত্রায় নজরে এল ।  
দশমীর দুপুর থেকে বাড়িতে শুরু হয়ে যেত নিমকী-নাড়ু আর ঘুগনীর তোড়জোড় । কত মানুষ আসবে বাড়িতে । কিন্তু এখন কোলকাতায় সেই রেওয়াজ যেন অনেকটাই স্তিমিত । দল বেঁধে যাওয়া হত বিজয়া করতে । প্রবাসে বসে আরো যেন এইগুলো পেয়ে বসে আমাকে । মনে হয় আমি যেন দলছুট এক কোলকাতাইয়া । তবে হাইটেক সিটি ছেড়ে যেতে যেতে কেবল মনে হতে লাগল আমার শহরের কথা । হায়দ্রাবাদ কোলকাতা দুই পুরোণো শহর । কিন্তু এ শহরে শুধু শিল্পের জোয়ার । শেষদিন খেতে গেছিলাম এক রেস্তোঁরায় । সেখানে বাঁকুড়ার এক বাঙালী যুবক হোটেলে কাজ করে । সে বলল তার দুঃখের কথা । দেশ ছেড়ে পুজোর সময় তার মোটেও ভালো লাগছেনা কিন্তু বাঁকুড়ায় পড়ে থাকলে তার সংসার চলবেনা  তাই কাজের জন্য দলে দলে ছেলেরা বাঁকুড়া ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পাড়ি দিয়েছে .. সে জানাল ।   আবারো মনটা ভারি হয়ে গেল তার কথাগুলো শুনে ।
দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকুক কোলকাতার বাঙালী । যদি মাদুর্গা ভবিষ্যতে প্রসন্না হন তবে আমাদের এই শহরেও শিল্পের জোয়ার আসবে ।  সেই সুপ্ত বাসনা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে ।   
আমাদের পরবর্তী  পিটষ্টপ ভাইজ্যাগ্-আরাকু ভ্যালিতে ।  ইষ্টকোষ্টের ধার ঘেঁষে  গোদাবরী এক্সপ্রেস ছুটে চলল ।  
আদরের নৌকায় প্রকাশিত  

২ অক্টো, ২০১৩

প্যাপিরাস ই-পত্রিকার পুজোসংখ্যা ২০১৩


মহালয়ার আগেই প্রকাশিত হল প্যাপিরাস ই-পত্রিকার পুজোসংখ্যা ২০১৩ । ধীরে ধীরে সকলের ভালোবাসায় প্যাপিরাস  তিনটে পুজো পার করতে চলেছে ।   আশাকরি সকলে পড়বে তোমরা ও তোমাদের বন্ধুদের জানাবে  প্যাপিরাসের কথা । আরো কেমন করে এই ওয়েবপত্রিকা  সুন্দর করা যায় জানালে খুশি হব । তোমাদের সুচিন্তিত মতামতের জন্য ইমেল ও প্যাপিরাসের কমেন্ট তো র‌ইলই । দুর্গাপুজোয় সকলে খুব ভালো থেকো । হৈ হৈ করে বেড়াতে যাও, ঠাকুর  দেখো । খুব আনন্দে খাওয়াদাওয়া করো সকলের সাথে । 
আবারো জানাই শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা । মহালয়ার আগমনীর সুরে সুরে থেকো সক্কলে মিলে ।   আবার  দেখা হবে  নতুন বছরে ।  

২১ সেপ, ২০১৩

ডালাস ডায়েরী

বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম অনেকদিন আগে । সেই নিয়ে আমার স্মৃতিচারণা আদরের ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে । 

৭ সেপ, ২০১৩

পর্বঃ রাজাবাজার


লেজ থেকে ইউনিভার্সিটির একলাফে ট্রানজিশান যেন একফোঁটা দস্যি ইলেকট্রনের গ্রাউন্ড লেভেল থেকে এক্সাইটেড স্টেটে ফার্স্ট ঝাঁপিয়ে পড়া । কত এনার্জি ওইটুকুনি ইলেকট্রনের ! চার্জড হয়ে তো আছেই সে ।
কো-এড বাতাবরণ । রঙীন চশমা চোখে আর সদ্য ফুটিফুটি যৌবনে পা রাখার আনন্দ । হেদোর মোড়ে ফুচকা তদ্দিনে পার্শিবাগানে পাড়ি দিয়েছে । বিধানসরণীর চাচার রোল তখন রাজাবাজারে ঊত্তীর্ণ ।
জীবনের সবচেয়ে ব্যস্ততার বছর দুটো কেটেছিল রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে । বেথুন কলেজের রক্ষণশীলতার লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে সেই প্রথম কো-এড বাতাবরণে গা ভাসানো ।

সে ছিল বৃষ্টিভেজা শ্রাবণ সকাল । রাজাবাজারে ক্লাস শুরু হ'ল । রোজ সাড়ে দশটায় ক্লাস শুরু । দক্ষিণেশ্বর থেকে ব্রেকজার্নি । অধিকাংশ দিন শ্যামবাজারে নেমে লেডিস ট্রাম ১২ নম্বরে চড়ে বসতাম । তারপর সার্কুলার রোড ধরে ট্রাম আমাকে বয়ে নিয়ে পৌঁছে দিত সায়েন্স কলেজ । শুরু হ'ল প্রতিনিয়ত যাতায়াতের লড়াই । কিন্তু দুবছরে কোনোদিনো আমি ফার্স্ট ক্লাস মিস করিনি । যারা কাছে থাকত তারা বরং লেট করে পৌঁছাত । স্যার একদিন বলেছিলেন "একে দেখে শেখো, She is nearest to the God, farthest from the Church!"
থিয়োরি ক্লাসের পর লাঞ্চব্রেক । তারপর প্র্যাকটিকাল ক্লাস । রোজ সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ ক্লাস শেষ হত । তারপর অফিসের ভীড় ঠেলে বাড়ি ফেরা ।
কলেজে ক্লাস শুরুর ঠিক পরেপরেই চোখে নিদারুণ কনজাংটিভাইটিস সংক্রমণ হল । নতুন ক্লাস আর দ্বিতীয় কেউ নেই যে আমার পড়া বুঝিয়ে দেবে । ক্লাস-নোটসের ওপর ভিত্তি করেই পড়া আর পরীক্ষা দেওয়া । তাই শুরু থেকেই হুঁশিয়ারি সেকেন্ড ইয়ারের দাদাদিদিদের "কোনো ক্লাস কামাই করবে না" । ইউনিভার্সিটিতে যারাই রক্ষক, তারাই ভক্ষক অতএব ক্লাসে যা পড়ানো হবে সেটা নিয়মিত ফলো করে গেলে আর তাকে ভিত্তি করে নিজে পাঁচটা জার্নাল আর ব‌ই ঘেঁটে নোটস বানিয়ে নিলেই ফার্স্টক্লাস অবধারিত । তাই নিদারুণ চক্ষুশূলেতেও বাসবদল করে আলমবাজার থেকে রাজাবাজারে গেছি ক্লাস করতে । ইউনিভার্সিটিতে প্রোমোশানের জন্য নতুন রোদচশমা চোখে সেদিন দুগ্গা দুগ্গা বলে কলেজে গেছি । ক্লাসরুমে ঢোকার মুখে আমার ক্লাসেরই একপাল ছেলে (তখনো আলাপ পরিচয় হয়নি তাদের সাথে ) তুমুল শব্দ করে উঠল । বুঝলাম যে আমাকে দেখে ওরা অমন করছে । চশমাটা কায়দা করে মাথায় তুলে তাদের দিকে চেয়ে বললাম " এই তো সবে ক্লাস শুরু হল, দুবছর তোদের সাথে ঘর করব কি করে! ক্লাসের বন্ধুকে তোরা আওয়াজ দিস বুঝি! বুঝতাম তোরা আমার সিনিয়ার তাহলেও নয় একটু আধটু raggingভেবে ক্ষমাঘেন্না করে দিতাম !"
সাথে সাথে আমার বন্ধুরা sorry বলেছিল । তারপর ওরা যে আমার কি ভালো এবং হেল্পফুল বন্ধু হয়ে উঠেছিল যে কি বলব ।
প্রতি শুক্রবার আমাদের থিয়োরি ক্লাস হত প্রেসিডেন্সি কলেজে । সেখান থেকে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে ট্রাম রাস্তা, অলিগলি দিয়ে পার্সিবাগান লেন ও সব শেষে সায়েন্স কলেজে এসে প্র্যাকটিকাল ক্লাস করা । সেই ফাঁকে পরিচয় হল কফিহাউসের সাথে । ঐ দুটো বছর অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছিলাম । কফিহাউস ছাড়াও সায়েন্স কলেজের ক্যান্টিন, সাহা ইনস্টিটিউট ও বোস ইনস্টিটিউটের ক্যান্টিনে দুপুরের টিফিন খাওয়ার মজাটাই ছিল অন্য স্বাদের । ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে পড়াশুনোও চলত সেই ফাঁকে ।

মনে পড়ে যায়...


দুপুরবেলার নিঝুম স্মৃতি, শান্ত পায়ে পথ চলা,
ক্লান্ত গায়ে কথা বলা রাজাবাজার কলেজ পারে,
ট্রামলাইনকে ক্রস করে, এপিসি রোড ছুঁতো শেষে
পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।

আমরা তখন স্নাতোকোত্তর, আমরা খোলা হাওয়া
স্বপ্ন নেশা চোখে মেখে, রঙীন হয়ে যাওয়া
খগেনদাদার চায়ের ঠেকে, ল্যাবের সেই কোণা
মিনিট পাঁচেক জিরেন, টেস্টটিউব হাতে নিয়ে...

সুলগ্নার বাসের প্রেমিক, কমলিকার দেখতে আসা,
সুদীপের স্বপ্ন দেখা,বিদেশ যাবার কত আশা !
অমৃতা আর সুমন জুটি, পাশাপাশি থাকত কেবল
গোপন প্রেমের কেমিস্ট্রিতে, গসিপ গিলি বন্ধু সকল..

সূয্যি ডোবে আঁধার নেমে আসে
কলিকাতা সাতলক্ষনয়, পার্শিবাগান লেনে ।
ফার্স্ট ইয়ারেই ভিসা পেল সুমন-অনীক-জয়দীপরা
হলনা কো অমৃতার সুমনের সাথে বাড়ি ফেরা..

র‌ইলো পথের ধূলোগুলো, উড়ে গেল কিছু
পার্শিবাগান চললে তুমি আমার পিছুপিছু
র‌ইলে নীরব প্রেমের তুমি , সাক্ষী হয়ে শুধু
রাজাবাজার, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।

আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ার, একশো কুড়ি জন
কফিহাউস, ব‌ইপাড়া, জটিল সমীকরণ ।
মাতাল হাওয়ায় উড়ে গেল, বুদবুদ উদ্বায়ী
হারিয়ে গেল ওরা যেন আজব পরিযায়ী

কফিহাউসের সাদা টেবিল লিনেনে
র‌ইল ছোঁয়া সাতাশি সালের ব্যাচ
র‌ইলে তুমি পড়ে পার্শিবাগান লেন
আর এপিসি রোড, কলিকাতা সাতলক্ষনয় ।

বিশুদ্ধ রসায়নের সিলেবাসের চাপে ঐ দুটো বছর কোথা দিয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত হয়েছিল তা টের পাইনি । তখনো আমার সাহিত্যের ধারাপাত অধরা, অনবরত মস্তিষ্কের রাসায়নিক বিক্রিয়ার টানাপোড়েনে ।
দিক্‌পাল সব কেমিষ্ট্রির অধ্যাপকের সান্নিধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ভবিষ্যতের দিশা । একদিকে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, অন্যদিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এহেন আমি হাবুডুবু খেতে খেতে অর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রিতে স্পেশালাইজ করলাম । ডাঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ জুলি ব্যানার্জি, ডাঃ অভিজিত্ ব্যানার্জি, প্রোফেসর তলাপাত্র, ডাঃ প্রিয়লাল মজুমদার, ডাঃ শিবদাস রায় এদের সাথে সর্বক্ষণের ওঠাবসা আমার জীবন রসায়নকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল । জৈব রসায়নের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ন্যাচারাল প্রোডাক্টস নিয়ে পড়াশুনো করতে করতে আশ্চর্য্য হতে লাগলাম । সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে শুতে যাওয়া অবধি জৈব রসায়ন আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে এই কথা ভেবে । চায়ের মধ্যে ফ্ল্যাবোনয়েডস, তারপর প্রাতরাশের ফ্রুট প্ল্যাটার ভর্তি রঙীন সব এন্টি কার্সিনোজেনিক বিটা ক্যারোটিন ! পরণের সূতির কাপড়... সে ন্যাচারাল পলিমার ফাইবার, আবার সিন্থেটিক শাড়ি বা ড্রেস মেটিরিয়াল সে সিন্থেটিক পলিমার । এইভাবে অর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রি তখন আমার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে । সিনথেটিক অর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রি আমাকে আবিষ্ট করে রাখত সে সময় । এন্টিবায়োটিক্স পড়াতেন প্রোফেসর কে এম বিশ্বাস । উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন । ডাঃ শিবদাস রায় পড়াতেন হেটেরোসাইক্লিক কম্পাউন্ডস । ডাঃ প্রিয়লাল মজুমদার পড়াতেন নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স আর এরোমেটিক কম্পাউন্ডস । প্রতিটি ক্লাস ছিল ভীষণ উপভোগ্য । স্যারের সাথে আমার খুব দোস্তি হয়েছিল । বাবা চাকরী করতেন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে । বাবাদের নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ হলেই সেই ওষুধের লিটারেচার নিয়ে স্যারের সাথে আলোচনায় বসতাম । স্যার শিখিয়েছিলেন ডক্টর কোনো ওষুধ প্রেসক্রাইব করলেই ওষুধের কম্পোজিশান পড়ে নিতে । সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে আমার বাড়িতে । কাশির ওষুধ সেই যে বাড়িতে ব্যান করেছিলাম আজো তেমনি আছে । এফিড্রিন দেওয়া কাফ সিরাপ যে কত ক্ষতিকারক স্যার বোঝাতেন । এছাড়াও হলুদের কারকিউমিনের কত গুণ বা খয়েরের ক্যাটেচিন যে কতখানি ক্ষতিকারক সেগুলো জেনেছিলাম । সালফার ড্রাগে আমার চিরকাল এলার্জি । এন্টিবায়োটিক সালফার ফ্রি কিনা ডক্টর প্রেসক্রাইব করলে এখনো নেট ঘেঁটে দেখে নি । এভাবেই চলছিল আমার জৈব রাসায়নিক দোস্তি ।
সায়েন্স কলেজের শেষবছর অর্থাত ১৯৮৬ সালে আমরা চুটিয়ে দিল খেলেছিলাম সকলে মিলে । তখন বসন্তে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পাসপোর্ট যেন পাওয়া হয়েই যেত সরস্বতী পুজোতে । তারপরেই দোল । অতএব সেই পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসা পেয়ে গেছি । তাই সব কিছুতেই মায়ের সায় । দোলের আগের দিন ক্লাস শেষ হবার পর কলেজের মাঠে ছেলেমেয়ে একত্র হলাম । সাথে নানা রংয়ের আবীর এনে প্রথমে স্যারেদের ঘরে ঘরে ঢুকে পায়ে দিয়ে প্রণাম করে আসা হল । সেবার প্রচুর ফাগ খেলা হল একপাল ছেলে মেয়েতে মিলে । সেই প্রথম ছেলে বন্ধুদের সাথে দোল খেলে লালটুকটুকে হয়ে লজ্জায় সবুজ হয়ে মিনিবাসে বাড়ি ফেরা । তবুও আনন্দ আকাশে বাতাসে । কারণ মম যৌবন নিকুঞ্জে তখন পাখিডাকার শুরু হয়ে গেছে । মা বরং খুশিই হলেন । এই তো জগতের নিয়ম । প্রকৃতির গাছে পাতা ঝরে নতুন পাতা আসবে । আমগাছে মুকুল আসবে । বাদাম গাছের পাতা ঝরে গিয়ে লাল ফুল সর্বস্ব গাছ হবে এই তো বসন্তের নিয়ম ! মায়ের একরত্তি মেয়েটা কেমন বড়ো হয়ে গেল! কিন্তু পুরোটাই খুব সুন্দর ভাবে । শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করে । বছর দুয়েক আগে দোলের আগের দিন কোলকাতার এক নামী কলেজের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম । দেখলাম ছেলেগুলি মেয়েদের সিঁথিতে সিঁদুরে আবীর ঢেলে দিচ্ছে নিপুণ ভাবে তারপর সেই লাল টুকটুকে সিঁথিতে মেয়েটি ছেলেটিকে জাপটে ধরে মোটরসাইকেলে করে এক নিঃশ্বাসে অন্তর্হিত হল সেখান থেকে ।
এখন ফাগুনের ফুল ঝরতে না ঝরতেই চকোলেট-ডে, প্রোপোজ ডে, হাগ-ডে, কিসিং-ডে, ভ্যালেন্টাইনস-ডে পেরিয়ে দোল দে । দোলের আবীরগুঁড়ো অহোরাত্র উড়তেই থাকে ফেসবুক জানলায়, দেওয়ালে, বারান্দায় । দোলের রঙের গড়িয়ে পড়তে লাগল অর্কুট অলিন্দ দিয়ে । সেই রঙ গিয়ে পড়ল ফেসবুক উঠোনে ।
এখন দোলের রঙের ওপরেও টেকশো ! রূপ সচেতন বঙ্গতনয়ারা স্কিনফ্রেন্ডলি রং চায় ! ইকোফ্রেন্ডলি আবীর, ভেষজ গুলালে ফ্যাশন ইন ! তাই ডিজিটাল দোল খেলো বাবা! নো হ্যাপা ! আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না, রং খেলবোনা !
ভাগ্যি সোশ্যালনেটওয়ার্ক ছিল প্রেমের সাথে ! দোলখেলার বৃত্তটা কিন্তু ছড়িয়েছে আগের থেকে । দোলখেলার প্রেম বেঁচে বরতে থাকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত । এখন দোলখেলার বাতাস সোশ্যালনেটওয়ার্ক ময়তায় । ফেসবুক উজাড় করে ঘন্টার পর ঘন্টা দোলখেলা পেরয় ডিঙিনৌকো করে । ডিজিটাল ঢেউ পেরিয়ে ট্যুইটারের চিলেকোঠাতেও মুখ লুকোয় সেই দোলখেলা । দোলের রং ঝরছে সর্বত্র । ফাগ উড়ছে অনাবিল আনন্দে ।
পড়াশোনোর চাপে আমাদের দোল ছিল প্রকৃত দোলের মতন । অন্যরকমের মাদকতা আর একটা বিশেষ ছুটির দিনে দোলকে দোলের মত করে পাওয়া ।
তখন না ছিল ইন্টারনেট না মোবাইল ফোন অথবা হাজারো কেবল চ্যানেল । অগত্যা দূরদর্শনের দোলের বৈঠকি ! তবে মায়ের হাতে স্পেশ্যাল রান্না ছিল সেদিনের মুখ্য আকর্ষণ ।
বেথুন কলেজে যেমন দুই মহিলা চন্দ্রমুখী দেবী এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর প্রথম স্নাতক হওয়ার শতবর্ষে আমি ছিলাম ঠিক তেমনি সায়েন্স কলেজে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপনের সামিল হবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । ১৮৮৬ সাল থেকে ১৯৮৬ এই একশো বছরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত নাম করা মানুষেরা কেমিষ্ট্রি পড়েছিলেন আর এহেন আমিও সেই ডিপার্টমেন্টের ১০০ বছরের একরত্তি ছাত্রী ! একসপ্তাহ ধরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ও রাজাবাজারে সায়েন্স কলেজে কত সেমিনার, লেকচার, সিম্পোশিয়াম হয়েছিল তার ইয়ত্ত্বা নেই । আমি ছিলাম প্রথম দিনের রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ত্বে । তারপর শেষদিনের খাওয়াদাওয়া ও নাচাগানা । ল্যাবের মধ্যে বিশাল বিশাল বাক্স প্যাকিং । পাশেই হচ্ছে রান্নাবান্না । লুচি, মুর্গির মাংস সব প্যাকিংয়ের দায়িত্ত্বে আমরা । সবশেষে প্রত্যেকের জন্য কেসিদাসের রসোমালাইয়ের ছোট্ট হাঁড়ির ভার নিয়েছিলেন কেসি দাসের বাড়ির মেয়ে মল্লিকার ঠাকুমা । মল্লিকা আমার সহপাঠিনী । আমি গিয়ে হাসিমুখে ঠাকুমাকে একটি বিজ্ঞাপন দিতে অনুরোধ করেছিলাম । ঐ বাড়ির অনেকেই সায়েন্স কলেজের স্টুডেন্ট ছিলেন তাই এই কলেজের ভালোমন্দে ওনাদের একটু দুর্বলতা ছিল ।এই যজ্ঞির দুমাস আগে থেকে সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কোম্পানির থেকে বিজ্ঞাপন চেয়ে আনার দায়িত্ত্বও ছিল আমি সহ একটি টিমের । কোথায় পাস্তুর ল্যাব, কোথায় ক্যালকাটা কেমিক্যালস, কোথায় বেঙ্গল কেমিক্যালস, হিন্দুস্তান লিভার , রেকিট এন্ড ক্যোলম্যান ও নামীদামী ফার্মাসিউটিকালের অফিস থেকে শুরু করে কলেজ স্ট্রীটে ছোট বড় সব ল্যাব ইকুয়িপমেন্টসের অফিসে পায়ে হেঁটে হেঁটে, ট্রামে, বাসে দৌড়ে মরেছি আমরা পয়সার জন্যে । তবে সায়েন্স কলেজের নাম শুনে কেউ মুখের ওপর দরজা বন্ধ করেনি সেটাই রক্ষে । আরো একটি কারণ হল এই সব কোম্পানিগুলোতে তখন সায়েন্স কলেজের পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা চাকরীতেও জয়েন করতে যেত । তখন ছাত্রদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার ঢল এতটা নামেনি ।

কত বাদামী বিকেল পেয়েছিলাম আমরা । জন্মদিনের সন্ধ্যে হত সেখানে । পরীক্ষার ভালো ফলের পার্টি হত অথবা কারোর সফল কোর্টশিপ । সেদিনের কফির পেয়ালার বিকেল আজো রয়ে গেছে... একমুঠো রোদ ভর্তি সকাল গড়িয়ে নোট তৈরী হতে হতে বিকেলের চৌকাঠে পা দেওয়া ।
শিল্পীর ক্যানভাসেও ছিল সেই রঙ ! মেহগিনি টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ত সেই রং । কবিতার খোলাখাতায় টুপটাপ ঝরে পড়ত সাবলীল শব্দকণা সেই মেহগিনি টেবিলে । যার ওপরে ধূমায়িত কফিবিন্‌সের গুঁড়ো গুঁড়ো গন্ধ হাওয়া ভেসে বেড়াত অনবরত ।
আমার একভুবন আকাশ জুড়ে তখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ আর কফিহাউসের আড্ডা ।
পেরেছ চিনতে বিকেল আমার?
একরাত স্বপ্ন নিয়ে, একসন্ধ্যে নেশা নিয়ে, একভর্তি হুল্লোড় নিয়ে
চেয়েছিলাম তোমায়, পেয়েওছিলাম তোমায়
রঙতুলির টানে সজীব হয়েছিল একরাশ চিন্তা-দৃশ্যপট !
আর সেই টেবিল ! সেই রাশিরাশি আড্ডা,
তুফানি তর্কের মুঠো মুঠো সংলাপ, যুক্তির খেল!
সেই সাদা নীলছোপ ধরা টেবিলক্লথ !
কত কাপ কফির উষ্ণতা !
কত ত্রিকিণমিতি, হাতে হাত ছুঁয়ে যাওয়া স্মৃতির পরিমিতি,
উপপাদ্যের ছেঁড়া পাতা, চিকেন কাটলেটের গন্ধ !
মনে পড়েছে তোমার ?
সেই পড়ন্ত বিকেলের ফুটপাথের ব‌ইপাড়া,
সেই আমাদের চলার সাক্ষী সব পুরোণো-নতুন ব‌ইয়েরা !
সেই রঙচটা, তার ছিঁড়ে দাঁড়িয়ে পড়া ট্রামেদের সারি।
কফির বাদামী গন্ধ কেড়ে নিয়েছিলে আমার থেকে,
নিয়ে গেছিলে সব রঙ তুমি ।
তবুও বেঁচে র‌য়ে গেলে সেই পুরোণো
রঙচটা ছাল ওঠা খোলসের শহরে..

সেই শ্রাবণের তুমি, ধরেছিলে বৃষ্টির রঙিন ছাতা,
কলেজবেঞ্চে থকে যাওয়া শীতের দুপুরে দিয়েছিলে
এককাপ ভর্তি অতিচেনা উষ্ণতা,
গ্রীষ্মের ল্যাব-পালানো চুপকথার গোপন দুপুর, আরো কত কি!

আমি আজও শুনতে পাই
সেই ভেঙে যাওয়া আড্ডা-বিকেলগুলোর কলকল শব্দ,
সেই ক্লান্ত একব্যাগ দুপুরের বয়ে চলার ফিসফিস
আর সেই টেবিলের চাদরের একটুকু ছোঁয়া লাগা কফির ধোঁয়ার ওম
সেই উর্দিপরা আমাদের আবদারের ক্লান্ত মানুষগুলো,
মাথার ওপরে পুরোনো গন্ধের পাখাদের বনবন শব্দকণারা
ঝরে পড়েছিল আমাদের কথাবৃষ্টির বর্ণমালার সাথে
মিশে গেছিল দুকূল ছাপানো কফির বাদামী গন্ধ নিয়ে..

আমি তখন ঊনিশ কুড়ির সাঁঝবেলা
তোমার আকাশ আমার আকাশকে
চিনিয়েছিল সেই বাদামী গন্ধ
আমি দাঁড়িয়ে র‌ইলাম সেই গন্ধ নিয়ে
সেই ওম নিয়ে, সেই রঙ নিয়ে