২৭ মার্চ, ২০২০

করোনা ডায়েরী

 
দুপুরে একটু তন্দ্রা আসছে আজকাল। কায়িক পরিশ্রম বোধহয় এর কারণ। অথচ রাতে ঘুম আসছেনা। খুব ভোরে অ্যালারম ছাড়াই ঘুম ভেঙে যেতেই মনে হচ্ছে একটা বিস্তারিত স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই মনে হচ্ছে আবার কি দুঃসংবাদ আসবে।  ছাদে বা বারান্দায় একটু চৈতি হাওয়া গায়ে মাখলেই মনে হচ্ছে ঠান্ডা অনুভূতি। জ্বর এল নাকি? কিম্বা কপালের রগদুটো কনকন করে উঠল কি? ভাবতে না ভাবতেই বাড়ির কেউ হয়ত হেঁচে ফেললেন। ৮৩ বছরের শাশুড়িমা দুবার কেশে উঠলেই শিরদাঁড়ায় কিসের যেন চোরাস্রোত ওঠানামা করে উঠছে। ভোরে উঠে এখনো দেখছি চরাচর জুড়ে গোলাপী কুয়াশা মাখা হিমেল আবহাওয়া। এমন হয় কি প্রতিবারের চৈত্রশেষে? তার মধ্যেও ছাদের আলসের ধারে বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাস মেখে ভুঁইচাঁপা তার উদ্ধত স্টক ফুঁড়ে মাটি ঠেলে বেরিয়ে এসে বলে ওঠে, আমায় দেখো একটু। কত রঙীন তার দেহ মন। ঠিক আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে আমাদেরো সবার যেমন ছিল। ফুলেল রক্তকরবী কে দেখে মনে হল তার সেই আত্মপ্রত্যয়েও যেন এবার কিছুটা হলেও ঘাটতি এবারের চৈত্রে। বসন্তের ফুল তুলে মালা গাঁথব বলেই না আমারা অনেকেই কোথাও না কোথাও পৌঁছে গেছিলাম হাজিরা দিতে। কেউ মিটিং এ, কেউ মিছিলে, কেউ সামাজিক দায়বদ্ধতায়। সেই সব তারিখগুলো মাথার ওপর এখন খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। কেউ জানিনা। এতদিনে বুঝলাম মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কি জিনিষ! সেদিন চৈত্রমাস! করোনার চোখে দেখব হয়ত আবারো আমাদের সর্বোনাশ! এবার চৈত্রে চড়কের ঢাকে কাঠি পড়ল না। বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে বলে চীৎকার করে সেই মাধুকরীর সিধে নিতে ওরা কেউ এল না এবার কেউ বাড়ি বয়ে। এবার আমাদের চৈত্র সেল নেই। ফুটপাথে হকারদের রমরমা নেই। আমাদের এখন উইকেন্ডের জন্য মনকেমন নেই। শুক্রবারের বিকেল থেকেই রবিবারের বায়নাক্কা নেই। কোনও প্ল্যান নেই আমাদের কারোর। ভোরে উঠলেই কাজের সহকারীর আমার বাড়িতে আসার কোনও অনিশ্চয়তা নেই। তার জন্য অপেক্ষাও নেই আমাদের। কি রান্না হবে তা নিয়ে বাজারের তাড়া নেই। অফিসের জন্য টিফিন নেই। তারমধ্যেও ছাদ বাগানের ফুল গাছেদের জল দিয়ে, ঘরের পোষ্যদের খাবারের ভাবনা আছে। নিজেদের সংসারের মাসকাবারির ফর্দ নেই। গল্প লেখার রসদ নেই। পঞ্চব্যঞ্জন ছেড়ে শুধু দিনগতে করোনা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছদনের উপায় বের করা আছে। কোথায় সবজীর খোসা ফ্রিজে জমিয়ে ডালের সঙ্গে ভাজা খাওয়ার বিলাসিতা আছে। ভাতের ফ্যানের স্যুপ কে নতুন মোড়কে আবিষ্কার করার নতুন ভাবনা আছে। আলুভাতের চমকদার রেসিপি ইনোভেশনের কৃতিত্ব আছে। গেরস্থ আলু পেঁয়াজ হিসেব করে খরচ করেনি এতদিন। এখন যেন মঙ্গলগ্রহের কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মত খাবারের হিসেব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। কটা আলু, কটা পিঁয়াজ রোজ রান্না হলে কতদিন যাবে । নতুন করে ঐকিক নিয়ম মাথা খাটিয়ে বের করছে সুগৃহিণী। যেন অর্ধভক্ষ ধনুর্গুণঃ। কিছু না পেলে আটা গুলে গোলা রুটিই খাব আমরা অথবা মাড়ভাতের স্যুপ । একটু সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা আর নুন ছড়িয়ে। খিদের মুখে তাই অমৃত হবে।
চৈতালী হাওয়া গায়ে মেখে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি ছাদ বাগান থৈ থৈ বাসন্তী ফুলে। আমার মনের অগোচরে। আজ বসন্তে আমার ফুল গাঁথার সময় নেই। তবুও ওরা সব ছাদ আলো করে দোল খাচ্ছে। কত আনন্দে, রঙীন হয়ে ফুটে রয়েছে। একে একে জড়াজড়ি করে, হাত ধরাধরি করে। আমার মনের খবর নেই ওদের কাছে।আমাদের এখন বেঁধে বেঁধে থাকার উপায়ও নেই। আমরা সবাই দূরে দূরে তবুও আমার কাছাকাছি ফুলেরা কাছে যেতেই বলে ওঠে
" কি গো দেখলে না আমায়?"
আমি বলে উঠলাম, দেখছিই তো কিন্তু পারবি তোরা সবাই মিলে সারাদেশের মানুষের মন ভালো করে দিতে? আচমকা দেখি রক্তকরবী খুব হাওয়ায় মাথা ঝুঁকিয়ে বলে উঠল, আছিই তো। চিন্তা কিসের?
অদৃশ্য সেই শক্তির কাছে বারেবারে নতজানু হই আমি। কে তিনি? শীতলা? রক্তকরবী? নাকি করোনার প্রতিষেধক?

কোন মন্তব্য নেই: