আমার
বেথুন কলেজ নিয়ে সবচেয়ে সুখের
স্মৃতি হল ফড়িয়াপুকুরের টাউন
স্কুলের পাশে স্যারের বাড়িতে
সপ্তাহে একদিন করে পড়তে যাওয়াকে
ঘিরে । আমরা বেথুনের সাত-আটজন
প্রতি শনিবার কলেজ ছুটির পর
হাঁটতে হাঁটতে হেদো থেকে বিধান
সরণী হয়ে পৌঁছাতাম টাউন স্কুলের
সামনে । আমাদের পথ-গল্পের
মুচমুচে গসিপ আর রূপবাণী
সিনেমা হলের উল্টোদিকের
ভুজিয়াওয়ালার কুড়মুড়ে সাড়ে
বত্রিশভাজা চলত মুঠো থেকে
মুঠোর পরে । অনার্সের পড়ার
চাপে আর কলেজ যাতায়াতের ক্লান্তি
যেন শনিবারের নিয়মিত পথচলায়
এক দমকা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আনত
। আমাদের স্যার মানে প্রোফেসার
বিবেক চ্যাটার্জি তখন জয়পুরিয়া
কলেজের কেমিষ্ট্রির অধ্যাপক
। নিঃসন্তান বিবেকবাবু ও ওনার
স্ত্রী (আমাদের
কাকীমা)
যেন
আমাদের সকলের পরিবারের দু'জন
হয়ে উঠেছিলেন । জীবনের ভালোলাগা,
মন্দলাগা,
সাহিত্যচর্চা
থেকে সিনেমা রিভিউ,
পিকনিক
যাওয়া থেকে হর্টিকালচারে
সদলবলে ফ্লাওয়ার শো সবকিছুর
সঙ্গী ছিলেন এই দুজন মানুষ ।
আমরা পড়তে যেতাম ইনর্গ্যানিক
কেমিষ্ট্রি বা বাংলায় যাকে
বলে অজৈব রসায়ন । স্যারের ঐটি
স্পেশ্যালাইজেশান । কলেজের
সবচেয়ে বোরিং ক্লাসগুলো
বিবেকস্যারের কৃপায় যেন সবথেকে
ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠত । ওই
বিষয়গুলো পড়তে ইচ্চে করত না
যতক্সণ না স্যার বুঝিয়ে দিতেন
গল্পের মত করে আর কোথা থেকে
কতটুকুনি পড়তে হবে বলে দিতেন
। বিশাল সিলেবাসের মধ্যে
স্যারের পরামর্শ পেলে পড়তে
আনন্দ হত । স্যার বলতেন "
যে
খাতা বা নিজের তৈরী করা নোটটা
থেকে পড়তে শুরু করবে সেই নোটটাই
পরীক্ষার শেষ দিন অবধি দেখে
যাবে তবে মনে গেঁথে থাকবে ।
আমরা
দলবেঁধে গল্প করতে করতে যেতাম
স্যারের বাড়ি । কোনো কোনো দিন
যেতে যেতে খিদে পেয়ে যেত খুব
। টাউন স্কুলের নীচেই একটা
মাদ্রাজী দোকানে অথেন্টিক
দোসা পাওয়া যেত । দোসা খেতাম
হৈ হৈ করে । তারপর শ্যামপুকুর
স্ট্রীট দিয়ে স্যারের বাড়ি
পৌঁছে আবার কাকীমর হাতের আচার
অথবা পড়ানোর ব্রেকে স্যারের
আনানো কচুরী-আলুরদম
। বৃষ্টি পড়লেই আমাদের বরাদ্দ
ছিল মোড়ের মাথার বিখ্যাত একটা
দোকানের তেলেভাজা-মুড়ি
। সেদিন আর পড়া হত না । ভূতের
গল্প শুনতে বসতাম । কাকীমাও
যোগ দিতেন আমাদের আসরে । এইভাবে
চলত আমাদের কেমিষ্ট্রি টিউশান
আর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের অনাবিল
আনন্দের মূহুর্তেরা ।
ইনর্গ্যানিক
কেমিষ্ট্রির বোরিং লেকচারগুলো
অনায়াস মনসিঁড়ি বেয়ে গেঁথে
যেত মাথায় । বিবেকস্যারের
অপত্যস্নেহে আর বৈচিত্রে
সেই বোরিং লেকচারগুলো যেন
ভালোলাগায় পরিণত হত । একটু
পড়া একটু গান অথবা একটু
খাওয়াদাওয়ার অনুষঙ্গ যে
রেগুলার পড়াশোনায় কতটা জরুরী
সেটা উপলব্ধি করেছিলাম কলেজে
পড়াকালীন ।
১৯৮৫
এ ইন্দিরা গান্ধী যখন নিহত
হলেন সারা কলকাতা জুড়ে কি
অবস্থা । পথরোখো,
বাস
বন্ধ । আমাদের ফিজিক্স
প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা ছিল
। মনে আছে বাস টবিন রোড অবধি
গিয়ে বলল আর যাবেনা । পরীক্ষা
দিতে হবে বলে পায়ে হেঁটে টবিন
রোড থেকে বিডন স্ট্রীট পৌঁছেছিলাম
। ফেরার সময় শিয়ালদহ অবধি
হেঁটে তারপর লোকাল ট্রেনে
দক্ষিণেশ্বর ফিরে মনে হয়েছিল
রাজ্য জয় করেছি । মনে মনে একদিকে
যেমন পায়ে ব্যথার জন্য এ শহরকে
কটাক্ষ করেছি আবার বাসের
বিকল্প ট্রেনের সান্নিধ্যে
এসে মনে হয়েছিল কি সুন্দর এই
শহরের যাতায়াতের নেটওয়ার্ক
।
আরেকবার
৫ই জুন ১৯৮৪ । কলিকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট ওয়ান
শুরু । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম
পরীক্ষা । সংস্কৃত কলেজে সিট
পড়েছিল আমাদের । ৪ঠা জুন থেকে
অবিরাম বর্ষণে শহর কলকাতা
বিপর্যস্ত । আমাদের মফঃস্বলও
জলমগ্ন ।
সকাল
আটটায় বাড়ি থেকে বেরুলাম ।
একটি ৩২ নম্বর বাস শ্যামবাজার
পাঁচমাথা মোড়ে নামিয়ে দিল ।
বিধানসরণীতে হাঁটু জল ।
সেন্ট্রাল এভিনিউ আর সার্কুলার
রোডও তথৈবচ । একটি টানা রিক্সা
৫০টাকায় কলেজ স্ট্রীট পোঁছে
দিতে রাজী হল । বাবার সাথে
রিক্সায় চড়ে বসলাম । রিক্সার
পাদানীতে থৈ থৈ জল । তখন না
আছে সেলফোন না আছে ইন্টারনেট
। এমন বন্যা কবলিত হয়ে আশা
করেছিলাম অন্তত সংবাদের
মাধ্যমে পরীক্ষা বন্ধের আদেশ
দেবেন কর্তৃপক্ষ । কিন্তু
সেখানে পৌঁছে অগণিত ছাত্রছাত্রী
পরিবেষ্টিত আমি...
কিছুটা
ধিক্কার দিয়েছিলাম এ শহরকে
। দশটা থেকে বারোটা বেজে গেল
কিন্তু কোনো খবর এলনা ।
প্রশ্নপত্র পৌঁছায়নি তখনো
আর আমরা ব্ইপত্র উল্টে চলেছি
। বারাসাত,
বসিরহাট
থেকে যারা এসেছে তারা তখন ফিরে
যাবার তোড়জোড় করছে । অশনি
সঙ্কেতের মত প্রশ্নপত্র হাজির
হল । বলা হল বেলা দুটোয় পরীক্ষা
শুরু হবে । আমরা সেই না খাওয়া
দাওয়া স্টেজে ম্লান মুখে
পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে দেখি
কোনো বিজলীবাতি নেই । অতিবৃষ্টিতে
ইলেকট্রিক কেবল জলের নীচে ।
মোমের আলোয় জীবনের প্রথম এবং
কঠিন অনার্সের পরীক্ষা দিতে
দিতে সোজা প্রশ্নের উত্তর
গুলোও মনে পড়ছিলনা ঠিকঠাক ।
এভাবে চার ঘন্টা পার করে বাইরে
এলাম । বাড়ি ফেরা হল আমার সেই
বন্ধু মল্লিকার গাড়িতে ;
ফিরে
এসে দূরাদর্শনের সংবাদে ঘোষণা
হল সেদিনের পরীক্ষা বাতিলের
কথা । এত কাঠখড় পোড়ানো সেই
পরীক্ষা বাতিলের খবরে খুব
রাগ হয়েছিল এ শহরের ওপর আর
পরীক্ষা কর্তৃপক্ষের ওপর ।
এমন নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়
! তার
কি ইনফ্রাস্ট্রাকচার !
আমারো
তখন ভোটাধিকারের বয়স । আমিও
তো এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের
এক জনমত । কিন্তু এ কি হাল আমার
শহরের !
কলকাতার
নামকরা মিষ্টি কেসিদাসের
বাড়ির মেয়ে মল্লিকার বাড়িতে
আমাদের ছিল নিত্যি আনাগোনা
। বাগবাজারের নবীন ময়রার
বিখ্যাত সেই বাড়িটা ছিল আমাদের
নিজের বাড়ির মত । কতবার যে ওর
সাথে আমরা ঐ বাড়িতে গেছি তার
ঠিক নেই । মল্লিকা খুব শান্ত
স্বভাবের মেয়ে ছিল । ও বেশি
কথা বলত না কিন্তু বলত তোরা
বলে যা আমি শুনে মন্তব্য করব
। কলেজ ছুটি থাকলে মল্লিকার
সাথে আমার চলত পত্র বিনিময় ।
আমার লেখার ভীষণ ভক্ত ছিল সে
। আমাকে সমানে মল্লিকা বলত
"তুই
কিন্তু লেখাটা চালিয়ে যা"
আমি
কোনো গুরুত্ব দিতামনা । মল্লিকার
বাবা-মায়ের
২৫ বছরের বিয়ের তারিখে আমাকে
কবিতা লিখতে বলেছিল । কুড়িবছরের
সেই আমি ছাই তখন বিয়ের কি বুঝি
!
যাইহোক
লিখে ফেললাম একখানা। সেটা
আবার ছাপিয়ে অতিথিদের হাতে
হাতে বিলি করা হয়েছিল । আমার
কাছে সেটা বিশেষ পাওনা । ওদের
বাড়িতে যাওয়া মানেই এক থালা
নানা রকম মিষ্টি ও নোনতা সহযোগে
জলযোগ । কলেজজীবনের আনন্দটা
আরেক কাঠি বেড়ে যেত সেই আতিথেয়তায়
। তারপর মল্লিকা বায়োকেমিস্ট্রি
নিয়ে মাস্টারস করল বালিগঞ্জ
সায়েন্স কলেজ থেকে আর আমি
গেলাম পিওর কেমিস্ট্রি পড়তে
রাজাবাজারে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন