৭ এপ্রি, ২০১৫

সুচিত্রা সেন তোমাকে...



ই চিঠিখানা লিখে রেখেছিলাম অনেকদিন ধরে। ভেবেছিলাম রেখে আসব তোমার লেটার বক্সে। আমার বাড়ির খুব কাছেই ছিলে এদ্দিন কিন্তু সময় হয়নি। তাই আরো একটু মনের কথা লিখে পাঠিয়ে দিলাম শূন্যের মাঝে, শান্তির বুকে, যেখানে তুমি আছো এখন... c/oসেই ঠিকানায় ।

সত্যি বলতে কি জানো ? সিনেমার বড় একটা ভক্ত আমি ন‌ই। তবে বাংলা সিনেমাকে ভালোবাসতে শেখা উত্তম-সুচিত্রার হাত ধরে। মা জোর করে পড়ার ব‌ই, গল্পের ব‌ই আর অঙ্কের খাতা থেকে মুখটা ঘেঁটি ধরে খানিকটা ঘুরিয়ে দিতেন রোববারের দূরদর্শনের ইভনিং শোয়ে। আর মাঝেমধ্যেই টিকিট কেটে সেই বেকার হোমমেকারকে ম্যাটিনী শোয়ের কম্পানি দিতে দিতে চিনে গেলাম সেই সিনে আইডল, বাংলাছবির গ্রেটা গার্বোকে। মনে মনে তারিফও করলাম সেই অতি প্রচলিত "নাক মাটামাটা চোখ ভাসা, সেই মেয়ে খাসা " প্রবাদটির। আলগা চটক, লালিত্য, ব্যাক্তিত্ত্ব এই সব শব্দগুলো সদ্য যৌবনা আমার জীবনের ধারাপাতে তখনো অধরা জানো? শিখতে লাগলাম।

মা-মাসীরা নাকি রফ্ত করত তোমার চলন-বলন, কথা বলার সময় কম্বুকন্ঠীর সূক্ষকৌণিক গ্রীবা হেলন আর সর্বোপরি তোমার গুরুগম্ভীর চাহনি। আমার এক মাসী ছিল জানো? তিনি তো আজীবন তোমার মত রামগড়ুরের ছানা হয়েই থেকে গেল। আমৃত্যু হাসলোনা একটুও! এই ছদ্ম গাম্ভীর্য্য নাকি রূপের একটা আলাদা মাত্রা এনে দেয়। তুমি কি সেই কারণে অত্ত গম্ভীর থেকেছ আজীবন? এখন মনে হয় আরেকটু চটুল তুমি হলেও হতে পারতে ! দা ভিন্সির মোনালিসার মত এক টুসকি হাসিও দেখতে পেলামনা আমরা । জাস্ট ভাবা যায়না! তুমি হাসছ তাও বিনিপয়সায়? মানে এমনি এমনি! এটাই বোধহয় জাদুকাঠি বা ট্রাম্পকার্ড যা ছিল তোমার হাতে। কি ঠিক বললাম তো? রহস্যময়ীর রসিকতা আবার পছন্দ হবেনা হয়ত! প্লিজ, রাগ কোরোনা। আমি কিন্তু মস্ত ফ্যান তোমার! শুধু একটু যদি বাইরে আসতে। ধরা দিতে! পথে হল দেরীর সেই সূক্ষ্ম, সি-থ্রু ডেক্রণ শাড়ি আর সাথে এয়ারহোষ্টেস ব্লাউজ! আমরাতো পলিমারের যুগের মানুষ! সে সময়ের ডেক্রণ আর এসময়ের পলিয়েষ্টারে আকাশ পাতাল ফারাক। মায়েরা সকলে কিনে ফেলল নিউমার্কেটে গিয়ে। বানিয়ে ফেলল তোমার স্টাইলে ব্লাউজ! আমি সেই ব্লাউজ টেঁকে নিয়ে কলেজ কেটে রূপবাণীতে "পথে হল দেরী" দেখতে বন্ধুদের সাথে! সাগরিকার বোট-নেক ব্লাউজ? আর দীপ জ্বেলে যাই ছবির শাড়ির পাড়-আঁচলে ছিটকাপড়ের প্যাচ ওয়ার্ক আর ম্যাচিং ব্লাউজ ? এখনকার নায়িকারা তোমাকে নকল করছে ভাবলেও সুখ হয় । ভাবো তোমার ব্র্যান্ড!

পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ায় আগুণ জ্বালিয়ে দিলে তুমি সেই ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ! কিন্তু ঐ পর্দার আড়ালেই। ফোটোগ্রাফের সেই মুখ মানুষ সামনাসামনি দেখবে বলে কত কসরত করল! তবুও তুমি সামনে এলেনা একটিবার। তোমার জীবন রসায়ন আজো অধরাই থেকে গেল তোমার হার্টথ্রবদের কাছে । কিন্তু তা তো হবার ছিলনা । সিলভার স্ক্রিনের সাক্ষ্য ও অলক্ষ্যের তুমিকে তো পাওয়া হলনা আমাদের!

আমি তখন ক্লাস এইট । দত্তা দেখেছিলাম। মোর বীণা ওঠে কোন্‌ সুরে বাজি গানের সাথে পর্দা উড়ছিল আর মধ্যে দিয়ে ঢেউ তুলে হেঁটে চলেছিলে তুমি লিপ দিতে দিতে। অত রাবিন্দ্রিক আর কারোকে মনে হয়নি । আমাদের স্কুলের অফ পিরিয়ড তখন ভরপুর সেই চাল-চলন নকলের মধ্যে দিয়ে। আমরা গাইছি, হাসছি ঠোঁটদুটো একটুকু ফাঁক করে আর কল্পনার রাজ্যে ভেসে ভেসে প্রত্যেকে সেই মহানায়িকার আসনে নিজেকে বসিয়ে চলেছি। তারপর দেবীচৌধুরাণী। দৃপ্ততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার সেই রূপ, আর আমাদের মুগ্ধতা।

আমার শাশুড়িমায়ের মুখে শুনেছিলাম, "হারাণো সুর দেখতে দেখতে ওনার লেবার পেন উঠেছিল। উনি সেই আসি আর যাই যন্ত্রণা চেপে রেখেও গুণগুণিয়ে উঠেছিলেন "তুমি যে আমার" এর সাথে। বসুশ্রী সিনেমা হল থেকে সোজা শিশুমঙ্গলে ভর্তি হয়েছিলেন সেরাতে। পুরোটা সিনেমার কিছু বাকী ছিল। তারপর সেযাত্রায় খালাস হওয়ার পর সদ্যপ্রসূতির সন্তান বাত্সল্য উথলে উঠবে কি তার তখন কি মনখারাপ হারাণো সুর শেষ হয়নি বলে। সেদিন তুমি চলে যাবার পর আবারো দেখলেন হারাণো সুর আর গল্প বলছিলেন তারিয়ে তারিয়ে।

আমার মায়ের মুখে শুনেছি আরেক গল্প। দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরের পাশেই মামার বাড়ি ছিল আমার। মায়েদের বন্ধুরা খুব সিনেমা দেখত হলে গিয়ে কিন্তু বাড়ির রক্ষণশীলতাকে ফাঁকি দিয়ে মায়েদের মাট্যিনি বায়োস্কোপ সেই অর্থে ব্রাত্য। এদিকে বন্ধুবান্ধবরা গল্প বলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে এসে, ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার্স তাদের নখদর্পণে কিন্তু মায়েরা চার বোন যেন লজ্জায় সেই কথোপকথনে অংশ নিতে পারেনা। দিদিমার মাধ্যমে দাদুর কানে তুলতে লাগল কানাঘুষো। দক্ষিণেশ্বর থেকে বরানগরে সিনেমা দেখতে যাওয়া মনে বিগ প্রজেক্ট। এদিকে উত্তম-সুচিত্রা জুটি কাঁপিয়ে তুলছে বাংলার আকাশ বাতাস! সিনেমা আসে, সিনেমা চলে যায়। কখনো কোনো হলে চলতেই থাকে গৌরবময় দশ-বারো-কুড়ি সপ্তাহ। দাদুও বুঝতে পারেন যে আর মেয়েদের আটকে লাভ নেই । সকলেই এখন মুক্ত ! হঠাত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে আসে। সিনেমাহলের পাসপোর্ট পেয়ে মায়েদের কপালে সুপারডুপার হিট অগ্নিপরীক্ষার টিকিট আসে দাদুর মারফত, ড্রাইভারের হাতে করে। মায়েরা তো আহ্লাদে ন'খানা ! থুড়ি! নয়জনা...তুতো বোনেদের ফোন করে আনিয়ে সকলের কানে কানে তখন গানে মোর ইন্দ্রধনু !

তারপর একে একে সাড়ে চুয়াত্তর, সবার উপরে, গৃহপ্রবেশ, দীপ জ্বেলে যাই, সাগরিকা । রেডিওতে অনুরোধের আসরে ফিল্মিগানের নোটেশন অব্যাহত থাকে।

মা সেবার ফার্স্ট ইয়ার। গরমের ছুটির ভোরবেলায় দাদু দক্ষিণেশ্বর গঙ্গায় স্নান করে এসে মায়েদের সংবাদ দিলেন

" কালীমন্দির চত্বরে তিল ধারণের জায়গা নেই, তোদের সুচিত্রা সেন এসেছে বিকাশ রায়ের সাথে কি যেন এক বাংলাছবির শুটিং চলছে সেখানে"

মায়েরা একপ্রকার নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে একছুটে মন্দিরে। গিয়ে শোনে উত্তর ফাল্গুনীর শুটিং চলছে। বিদেশ থেকে তখন সদ্য ফিরেছেন সুচিত্রা, সাত পাকে বাঁধার জন্য পুরষ্কৃত হয়ে। তাই খুব ভীড়। কালীমন্দিরের সিঁড়ির সামনে বিকাশ রায় ও তিনি তখন পুজো দিয়ে নেমে আসছেন মায়ের চোখের সামনে । দুহাত দূরে তিনি। কিন্তু ঐ মুখে একটুও হাসি নেই। সেই ছদ্ম গাম্ভীর্য ভরা সুখ চোখে মুখে আর উপছে পড়া ব্যাক্তিত্ত্ব গড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর দিয়ে । তবে তাঁর মুখে হাসি থাক আর না থাক মায়েরা তো ফিদা সেই অর্থে!

এমন ফিল্মি নবজাগরণ তুমিই আনতে সক্ষম হয়েছিলে। কনসার্ভেটিজমের লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে মধ্যবিত্ত যুবতীদের মনে সেই আঁধি আনলে ! কিন্তু সব ছিল ভালো যদি শেষটুকুনি আরো ভালো হত। সেযুগের আরো এক মহানায়িকা ঊমাশশী বা থিয়েটারমঞ্চ কাঁপানো নটী বিনোদিনীর মত সেই যে আড়ালে চলে গেলে অর এলেনাকো! কেউ বলল, তোমার নাকি আধ্যাত্মিক চেতনা এসেছে। কেউ বলল, তুমি সংসার জগতের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছ। কেউ আবার বলল তোমার শেষ ছবি প্রণয়পাশার বিফলতা তোমাকে হতাশ করেছে বলে তুমি আর ফিরতে পারলেনা। তদ্দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটি ভেঙে খান খান। তাই চলচিত্র জগতের ওপর বীতরাগ । তাই বলে যে দর্শক তোমাকে এত দিল তাদের জন্য একটি বার সাড়া দিলেনা তুমি! এ তোমার কেমন মহান আদর্শ! তুমি কি এমনি মহতী? জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে চলে বিলীন হয়েছ চিতার আগুণে । আত্মা অবিনশ্বর তাই তুমিও সর্বভূতে বিলীন হলে ঠিক‌ই কিন্তু আমার চোখে বহুদিন আগেই তুমি নিরালম্ব, নিরাশ্রয় আত্মার মত সেই কিংবদন্তী রূপসী হয়ে র‌ইলে । তোমার চলার পথ যদি এভাবে না শেষ হত!

আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার জীবনের সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়. সূর্য ডোবার পালা যদি আরো অন্যরকমভাবে আসত !

তুমি না হয় রহিতে কাছে, কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে !

ইতি

...

২৮ মার্চ, ২০১৫

রামায়ণ না কি সীতায়ণ ???


চৈত্রমাস নাকি মধুমাস। কারণ রামায়ণের হিরো রামের জন্মমাস।আজ শুক্লা চৈত্রনবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন? যে মানুষটা গণতান্ত্রিক স্বার্থে বৌকে ত্যাগ দিয়েছিল ? রাবণের ঘরে সীতার দিনযাপনকে কলঙ্কিত করে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিল তার জন্য ঘটা করে জন্মদিন? মানতে বড় কষ্ট হয়। আদর্শবান পুরুষচরিত্র হয়েও সীতার দুঃখ বুঝতে পারেনি সে হেন পুরুষনায়কের জন্য ছেলের মায়েরা রামনবমীর উপবাস করেন। ভাবতে কষ্ট হয়। মনে মনে বলি, রামের চৈত্রমাস, সীতার সর্বনাশ।
কৈ সীতার আত্মত্যাগের জন্য কেউ তো সীতার জন্মদিন পালন করেনা? রামকে নিয়ে কত ভজন গান হয়। কিন্তু সীতার জন্য ক'জন ভজন গান? এমনকি "পঞ্চকন্যা"... অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীর সাথে এক আসনেও সীতা স্মরেণ্যা ও বরেণ্যা নন। রাম নাকি দ্বাপরে কৃষ্ণের অবতার। তাই তার সাতখুন মাপ? এই রাম রাবণকে যুদ্ধে হারিয়ে বধ করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করেছিল। মা দুর্গার স্তব করেছিল। আর শরতকালে দুর্গাপুজো করবে বলে দেবতাদের ঘুম পর্যন্ত ভাঙিয়েছিল অকালবোধন করে। রাম ঘরের সম্মান রাখতে পারলনা অথচ নিজের স্বার্থে দুর্গা নামে আরেক শক্তিশালী নারীর পুজো করতেও পিছপা হলনা!
হায়রে! হিপোক্রেসি ভারতের ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রয়োজনে এক নারীর পায়ে একশো আট পদ্ম দিয়ে পুজো হল অথচ রাবণ বধ করে সীতাকে লাভ করে অন্যের কথায় বৌকে ত্যাগ দিল! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠাতে যার একটুও বুক কাঁপলনা !

এ হেন রামের অয়ন অর্থাত গমন পথকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ। কিন্তু সীতার পাতাল প্রবেশ কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা কি তাকে মনে রাখেনা? সীতা মাটির কন্যা আবার মাটিতেই মিশে গেছিলেন। তাই সীতায়ণ (কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর দেওয়া এই নাম, আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে মনে মনে বলি) বা সীতার গমন পথও তো হতে পারত এই মহাকাব্যের নাম।
 মাটির কন্যা সীতা লাঙ্গলের ফলা বা "সীত" থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার অত্যাচারে, লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে বসুন্ধরার কোলেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই  নিজের জীবনচক্র তো নিজেই সমাপ্ত করলেন। তাই সীতার গমন পথ নিয়ে নতুন রামায়ণ লিখলে হয়না??? রাম কে এত প্যাম্পার করে, আদর্শের মুন্ডপাত করে হোক না সীতায়ণ!!!  

৪ মার্চ, ২০১৫

বাসন্তী ধৌতিকরণ ও দোল

গোর দ্বন্দ। কিসের ইগো?  বাপ্-বেটার ইগো। কেন ইগো? এ হল ধর্মান্ধতার ইগো।   বাপ হলেন স্বৈরাচারী দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপু আর ব্যাটা হল বিষ্ণুর আশীর্বাদ ধন্য প্রহ্লাদ। আর বাপ হলেন গিয়ে anti-বিষ্ণু।  বাপ রাজা তাই can do no wrong। ব্যাটা ঠিক উল্টো। বিষ্ণুর সমর্থক, বিষ্ণু অন্ত প্রাণ।
 কশ্যপমুনির স্ত্রী দিতির দুই পুত্র। দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র দেবকুল তখন সন্ত্রস্ত  । বিষ্ণু বধ করলেন হিরণ্যাক্ষকে।  এবার হিরণ্যকশিপু ভ্রাতৃহন্তা বিষ্ণুর ওপর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠল। মন্দার পর্বতে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার বর পেল সে। দেব, দৈত্য, দানব কেউ তাকে বধ করতে পারবেনা। এইবার খেলার শুরু। 

  শুরু হল একুশে আইন। হিরণ্যকশিপুর আপন দেশে বলবত্‌ হল নয়া আইন। কেউ বিষ্ণুপুজো করতে পারবেনা। এদিকে তার ছেলেই তো পরম বৈষ্ণব। তাহলে? তাহলে আর কি মার ডালো। আবার যে কেউ মারতে পারবেনা তার ছেলে প্রহ্লাদকে। রাজ্যের সব বিষ্ণুভক্তকে তিনি শূলে চড়িয়ে মৃতুদন্ড দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের বেলায় কি করবেন? বুদ্ধি খাটালেন বাপ। সুইসাইড বম্বার চাই তাঁর। কে হবে সেই আত্মঘাতী ঘাতক যে কিনা নিমেষে শেষ করবে তার পুত্রকে? বাপের দুষ্টু পাজী এক বোন ছিল। তার নাম হোলিকা। যুগে যুগে যেমন থাকে আর কি! সংসারে ভাঙন ধরায় তারা, দুষ্টু বুদ্ধিতে ছারখার করে ভাইয়ের  সংসার। হোলিকার কাছে ছিল এক মায়া-চাদর।  

 
তৈরি হল বিশেষ ঘর। সেই ঘরে হোলিকা প্রবেশ করল প্রহ্লাদকে নিয়ে।  হোলিকা ভাইপো প্রহ্লাদকে তার কোলে নিয়ে  বসবে। আগুণ জ্বালানো হবে এমন করে যাতে ঐ মায়া চাদর হোলিকাকে রক্ষা করবে আর প্রহ্লাদের গায়ে আগুণ লেগে সে পুড়ে মরে যাবে। কৌশল, ছলনা সবকিছুর মুখে ছাই দিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল।  অগ্নি সংযোগ হল । মায়া চাদর হোলিকার গা থেকে উড়ে গিয়ে নিমেষের মধ্যে প্রহ্লাদকে জাপটে ধরল। হোলিকা পুড়ে ছাই হল আর প্রহ্লাদ তখনো অক্ষত। 

হোলিকা দহনের সময় আখের গায়ে সপ্তধান্য বা ধান, গম, যব, ছোলা এমন সাতরকম শস্যের গাছ বেঁধে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। প্রহ্লাদকে রক্ষা করেছিলেন বলে অগ্নিদেবকে এই শস্যদান।  
পুরাণের এই হোলিকা দহন বা আমাদের আজকের ন্যাড়াপোড়া বা বুড়ির ঘর জ্বালানোর কারণ হল অশুভ শক্তির বিনাশ আর পরেরদিনে দোল উত্সবে আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নিয়ে শুভ শক্তিকে বরণ করা। অথবা যদি ভাবি বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে? বছরের শেষে  পুরণো স্মৃতি, জীর্ণ, দীর্ণ সবকিছুকে জ্বালিয়ে দিয়ে নতুন বছরকে সানন্দে বরণ করার আগাম তোড়জোড়? কিম্বা বসন্তে ঋতু পরিবর্তনে রোগের বাড়াবাড়িকে নির্মূল করতে এই দহনক্রিয়া??? আর সামাজিক কারণ হিসেবে শীতের শুষ্ক, পাতাঝরা প্রাকৃতিক বাতাবরণকে পুড়িয়ে সাফ করে কিছুটা  বাসন্তী ধৌতিকরণ। যাকে আমরা বলে থাকি  spring cleaning। সে যাইহোক দোল পূর্ণিমার আগের রাতে খেজুরপাতা, সুপুরীপাতা আর শুকনোগাছের ডালপালা জ্বালিয়ে আগুণের চারপাশে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মহা উত্সাহে নৃত্য  করে করে গান গাওয়াটাই যেন আরো সামাজিক।
"আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল"
এবার সেই হরিবোলের সূত্র ধরে মনে পড়ে যায় মথুরা-বৃন্দাবন সহ ভারতের সর্বত্র দোলের পরদিন হোলি উত্সবের কথা। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আর রং খেলার আনন্দে সব কালিমা , বৈরিতা মুছিয়ে দেওয়া আর বার্ষিক এই উত্সবের আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়া। বাংলার দোলযাত্রা আরো একটি কারণে বিখ্যাত । নবদ্বীপে দোলপূর্ণিমার দিনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা শ্রীচৈতন্যদেব। তাই এই পূর্ণিমার অপর নাম চৈতন্যপূর্ণিমা। বাংলার ৮৯১ সনে, ১৪০৭ শকাব্দে ও ১৪৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের স্ত্রী শচীদেবীর কোল আলো করে এসেছিলেন তিনি  । একটি প্রাচীন নিমগাছের নীচে জন্ম হল তাই নাম রাখা হল নিমাই। আবার গৌরকান্তির জন্য কেউ নাম দিল গৌরাঙ্গ। জগন্নাথ ডাকলেন বিশ্বম্ভর ও আত্মীয়েরা ডাকলেন গৌরহরি। এ যেন দুর্জনদের হাত থেকে সমাজকে বাঁচানোর তাগিদে কলিযুগের মাটিতে অবতার হয়ে জন্ম নেওয়া শ্রীকৃষ্ণের।  তাই নবদ্বীপে এই দোলযাত্রা আজো মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়।   

১৩ ফেব, ২০১৫

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে




সুলতান লিখতেন কবিতা । রাণী গাইতেন গান । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক গল্প শুনতে মধ্যপ্রদেশের মান্ডু যাওয়া আমাদের । এখনো মধ্যপ্রদেশের মালওয়ার চারণকবিরা গেয়ে থাকেন কবি এবং রাজপুত্র বাজ বাহাদুর আর তার হিন্দুরাণী রূপমতীর প্রণয় গাথা ।




হোসং শাহের আমলে মান্ডু তার অর্থ, প্রতিপত্তি এবং ঐশ্বর্যে খ্যাতি লাভ করে । অনেক হাত বদলের পর ১৫৫৪ সালে বাজ বাহাদুর ক্ষমতায় আসেন । বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন সুলতান । সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অকুন্ঠ ভালবাসা । কুমারী রূপমতী ছিল এক অতি সাধারণ হিন্দু রাজপুত ঘরের অসাধারণ রূপসী তনয়া । তার গলার স্বরে ছিল এক অনবদ্য মিষ্টতা যা আকৃষ্ট করেছিল বাজ বাহাদুরকে । একদিন শিকারে বেরিয়েছিলেন বাজবাহাদুর । বাগাল, রাখাল বন্ধুদের সাথে রূপমতী গান গেয়ে খেলে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনে । সুলতান তাকে দেখে তার সাথে রাজপুরীতে যেতে বললেন এবং তাকে বিয়ে করবেন জানালেন । রূপমতী একটি ছোট্ট শর্তে সুলতানের রাজধানী মান্ডু যেতে রাজী হলেন । রূপমতী রাজার প্রাসাদ থেকে কেবলমাত্র নর্মদা নদীকে দর্শন জানাবার বাসনা জানালেন । বাজ বাহাদুর সম্মত হলেন । সুলতান তার হবু বেগম রূপমতীর জন্য পাহাড়ের ওপরে বানালেন এক ঐশ্বরীয় রাজপ্রাসাদ যার নাম রূপমতী প্যাভিলিয়ন এবং যার ওপর থেকে রূপোলী সূতোর এক চিলতে নর্মদাকে রোজ দর্শন করে রাণী তবে জলস্পর্শ করতেন । নর্মদা ঐ পথে এঁকে বেঁকে পশ্চিম অভিমুখে আরবসাগরে গিয়ে পড়েছে । রাণীর জন্য তৈরী হল পুণ্যতোয়া নর্মদার জলে রেওয়া কুন্ড । হিন্দু এবং মুসলিম উভয় রীতি মেনে বিবাহ সম্পন্ন হল তাদের কিন্তু পরিণতি সুখকর হলনা । মোঘল সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে অধম খানকে মান্ডুতে পাঠালেন শুধুমাত্র মান্ডু দখল করতেই নয় রূপমতীকে ছিনিয়ে আনতে । বাজ বাহাদুরের ছোট্ট সেনাবাহিনী পারবে কেন সম্রাট আকবরের সেনাদের সাথে ? বাজ বাহাদুর ভয়ে চিতোরগড়ে পালিয়ে গেলেন রাণীকে একা ফেলে রেখে । রূপমতী সেই খবর পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক রূপকথার ভয়ানক পরিসমাপ্তি ঘটল । এখনো রূপমতী প্যাভিলিয়নে হয়ত বা ঘুরে বেড়ায় রূপমতীর অতৃপ্ত আত্মা । চুপকথার চিলেকোঠায় চামচিকেরা আজো শুনতে পায় তার পায়ের নূপুরের শব্দ । দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় একটাই শব্দ যার নাম মেহবুবা । এখনো রাজপ্রাসাদের মধ্যে সেই ক্যানাল দিয়ে কলকল করে জল বয়ে চলেছে অবিরত । নর্মদাও রয়ে গেছে আগের মত শুধু রূপমতীই পারলেন না এই মহল ভোগ করতে । বাজ বাহাদুর রেওয়া কুন্ড নামে একটি জলাধার বানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী রূপমতীর জন্য । বাজবাহাদুরের প্রাসাদ এবং রূপমতী প্যাভিলিয়ন এর আফগান স্থাপত্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। 
 

মান্ডু দেখা শেষ হল কিন্তু গাইডের বলা রূপমতী আর বাজ বাহাদুরের প্রেমের গল্প লেগে রয়ে গেল কানে । কিছুটা প্রতিধ্বনি, কিছুটা উদ্বায়ী আবেগ, কিছুটা এলোমেলো চিন্তার জটে সেই কাহিনী হোটেলে ফিরে এসে লিপিবদ্ধ করলাম ।


১২ জানু, ২০১৫

১২ই জানুয়ারি ! নমি গুরু বিবেকানন্দম্‌ !



খন্ডন ভব বন্দন জগ বন্ধন বন্দি তোমায় !!!

সেই একরত্তি বিলে থেকে পূর্ণযুবক নরেন ও সেখান থেকে সচ্চিদানন্দ বিবিদিষানন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দ বলে আমরা যাঁকে জানি তিনি হলেন আধুনিক ভারতবর্ষের যুবজাগরণের পথিকৃত । সেই যুগনায়ক  মহাসন্ন্যাসী ভারতবাসীকে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছিলেন এক লহমায়..  হিন্দুত্বের দাবী নিয়ে, বেদান্তের প্রচার নিয়ে ।শিকাগো ধর্ম মহাসভায়  সকল ধর্মগ্রন্থের নীচে ভাগবদ-গীতার অধিষ্ঠানকে সকল ধর্মের ধারক রূপে ব্যখা করেছিলেন  । 
সমগ্র বিশ্বকে যিনি দেখেছিলেন এক ব্যয়ামাগার রূপে এবং মানুষকে সেই বিশেষ ব্যয়ামাগারে বলিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠতে বলেছিলেন ।
ছোটবেলা থেকে গরীবের দুঃখে যাঁর প্রাণ কেঁদে উঠত সেই বিলে আলনা থেকে মায়ের কাপড়চোপড় ভিখারীকে দান করেছিলেন সেইদিনই প্রমাণ হয়ে গেছিল তাঁর সারাটিজীবন ধরে "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"র   অমোঘ বাণীটি কতটা সত্যি । 
 দুর্বার গতিতে দুরন্ত  ঘূর্ণির পাকে সমাজের রং বদলে যায় । স্বামীজির অগ্নিমন্ত্রের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে । 
নারীজাতিকে সম্মান করার কথা বলেছেন স্বামীজি । বেলুড়মঠে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীতে কুমারীপূজার প্রচলন করেন তিনি । কিন্তু আমরা এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সেই কুমারীদের অবহেলা করি । কন্যাভ্রূণ হত্যা করে চলি । ধর্ষণে, অপমানে লাঞ্ছনার স্বীকার কন্যারা।  
স্বামীজি অশিক্ষা এবং কুশিক্ষাকে সমাজের অগ্রগতির প্রধান বাধা বলেছিলেন ।  কিন্তু আমরা এখনো বুঝি দূর করতে পারলামনা অশিক্ষা ও কুশিক্ষার প্রসার । তাহলে আজকের দিনটিতে সার্ধশতবর্ষের জন্মদিনে কি উপহার দেব তাঁকে ? 
"জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"   কিন্তু কোথায় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা? কোথায় বা মানুষের কর্মযোগ । স্বামীজি বিলেত-আমেরিকায় যে প্রকান্ড কর্মকান্ড দেখে এসেছিলেন সেই   কর্মোদ্দীপনার বীজ ছড়িয়েছিলেন সারা ভারতের মাটীতে  এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই বীজকে মহীরুহে পরিণত করতে চেয়েছিলেন । তিনি সফল । স্বামীজি কিন্তু নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিশন প্রতিষ্ঠা করেননি । প্লেগরোগীদের দুদর্শা, অনাহারী, আর্ত মানুষের  দুঃখ   মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন । সেবায় নিয়োজিত  করেছিলেন নিজেকে । জীবে প্রেম ও জীবের সেবা করার উদ্দেশ্যই কেবল  লক্ষ্য ছিল তাঁর । তাই শুধু সন্ন্যাসী নয় গৃহীদের ওপরেও ভার দিয়েছিলেন সেই সেবার । তাঁর ধর্ম নিষ্ক্রিয় বেদান্ত ছিলনা । ফলিত বেদান্তে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি । হাতেকলমে বেদান্তের প্রচার চেয়েছিলেন তিনি । তাঁর মূল কথা ছিল কি গৃহী অথবা সন্ন্যাসী সকলকেই কাজ করে যেতে হবে দেশের উদ্দেশ্যে, দশের সার্বিক উন্নয়নে ।   তাঁর  মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধ্যাত্ম চেতনার নতুন দিশা দেখতে পেয়েছে ভারতবাসী । কিন্তু আজ বড় বেশি করে মনে হয় তাঁর মত দেশ নেতা এবং কর্মযোগী এক মানুষের এই মূহুর্তে খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের । তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে তা আমাদের বাংলার তথা দেশের জন্য মঙ্গলকর হতে পারত । তিনি যা চেয়েছিলেন তার কিছুটা হয়ত সার্থক ভাবে রূপায়িত হয়েছে কিন্তু আমাদের প্রকৃত মানুষ হবার খুব প্রয়োজন ছিল এই মূহুর্তে । কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং রাজযোগের সারকথা পুঁথিতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল । আমরা না হতে পারলাম তাঁর উপযুক্ত উত্তরসুরী না পারলাম উপরের চারটি  যোগের একটিরো আলোকবর্তিকা বহন করতে । শুধু রামকৃষ্ণ-মিশনের দীক্ষা নিয়ে, ১২ইজানুয়ারীর প্রভাতফেরী করে আর বিবেকমেলা প্রাঙ্গণে হাজির হলেই তো প্রকৃত মানুষ হওয়া যাবেনা ।
 পাশ্চাত্যের সারটুকু নিয়ে প্রাচ্যে বিলিয়েছিলেন তিনি । এই দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধনে আমরা যেন হারিয়ে গেলাম । আমরা কি পারলাম দেড়শো বছর পর তাঁকে  উপহার দিতে এমনি এক দেশকে যেখানে দারিদ্য নেই, হাহাকার নেই, ধর্মের ভেদাভেদ, হানাহানি নেই ?
তিনি বলে ছিলেন "উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত, প্রাপ্যবরাণ নিবোধত"  প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই নিহিত থাকে অফুরান শক্তি  শুধু তাকে জাগ্রত করার অপেক্ষায় । তাই মানুষের কুলকুন্ডলিনী যেদিন সদবুদ্ধি দিয়ে জাগ্রত হবে সেদিন হবে সত্যিকারের  জয় ।   কিন্তু সত্যি কি আমরা উঠে দাঁড়াবো কিম্বা জাগব ? কোথায় যাবো আমরা ? কি আমাদের উদ্দেশ্য ?  রামকৃষ্ণ মিশনের লক্ষ্য তো সঞ্চারিত হতে পারত দেশের প্রতিটি কোণে কোণে, মানুষের চরিত্র গঠনে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে । তাহলে সমগ্র দেশ ঐ মিশনের অনুগামী হত হয়ত । স্বার্থত্যাগী দেশনেতা কি আছেন যিনি সেই সর্বত্যাগী অমিতবীর্য মহাসন্ন্যাসীর মত দুইটি ডানা দিয়ে আগলে থাকবেন সমগ্র দেশবাসীকে, অভয় দেবেন আর ভালোবাসা দিয়ে জয় করবেন মানুষকে। কাজ করবেন নিজের দেশের জন্য, ভাববেন দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য । যাতে দেশটা দেখে  পাশ্চাত্যের সূর্যোদয় । যে সূর্যটা আকাশে সাতটি রং ছড়ায় কিন্তু একটি মাত্র একতার সূর্যরশ্মি দিয়ে মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে ।  সমগ্র দেশের "ভালো"র স্বার্থে মানুষ সেই একরজ্জুতে  বাঁধা হয়ে এককাট্টা থাকেন ।  
তাই আবারো স্বামীজির কথায় বলি " Arise, awake and stop not till the goal is reached " 
বারে বারে ফিরে আসুক আমার প্রিয় স্বামীজির জন্মদিন, ১২ই জানুয়ারি।


৯ জানু, ২০১৫

মৃগদাব গড়চুমুকে, পিকনিক ২০১৫

সেদিন ছিল রোদ গলে পড়া শীতভোর। সেদিন ছিল নদীর জলের ঠান্ডা ভোর। পোষের পিঠে চড়ে রোদ এসে নেমেছিল গড়চুমুকে। মৃগদাব গড়চুমুকে। আমাদের চড়ুইভাতির সকাল তখন অমৃতকমলার দেশে পাড়ি দিয়েছে। সাদাসাদা ফুলকো লুচি আর নতুন আলুর সাদা চচ্চড়ির গন্ধে মাত গড়চুমুকের নদীর ধার। আমরা একদল শহুরে গিয়ে হাজির হলাম। শীতের সব অনুষঙ্গ যেমন নলেনগুড়, কমলালেবু, মটরশুঁটি, লেপ-বালাপোষ, পশমিনা-পুলওভার নিমেষে উধাও চড়ুইভাতির আনন্দে। শুধুই  শান্তি জলের ধার। শুধুই শান্তি নীল আকাশ। নীল আকাশ গিয়ে চুমু খেয়ে নিল দামোদরের পাড়কে।  নদের জল উছলে উঠল ছলাত করে। একটু ছুঁয়ে নিল নদের পাড়ের ক্যাসুরিনার নুয়ে পড়া সবুজ পাতা ভরা ডালকে। এখানেও সেই পোষমাস। যা এসেছে আমাদের শহরেও। এখানেও সেই শীত যা আছে আমাদেরো। এখানেও পারদ নামে প্রতিবারের মত। শীত আসে, শীত যায়। চড়ুইভাতি ফুরিয়ে যায়। আমরাও পরিযায়ীর মত ঘরে ফিরে যাই । শীতঘুমিয়ে ফুরিয়ে যায় শীত।

ভাগীরথী ও দামোদর মিশেছে হাওড়া জেলার গড়চুমুকে।   ৫৮ গেট বলে জল ধরে রাখার ও ছাড়ার বিশাল স্লুইসগেট। ডিয়ারপার্ক। জমপেশ উদরপূর্তি,গানের লড়াই,কুইজ,খেলা । সবমিলিয়ে শীতের অমৃত কমলার দুপুর জমজমাট!


৬ জানু, ২০১৫

কার্তিকেয় বৃত্তান্ত

কার্তিকঠাকুর আসলে কে ?
কেউ তাঁকেে বলে স্কন্দ, কেউ বলে মুরুগন আবার কেউ ডাকে সুব্রহ্মণ্য বলে। তিনি আসলে দেব সেনাপতি, যুদ্ধের দেবতা । আমাদের কাছে জনপ্রিয় কার্তিকেয় বা কার্তিক নামে, শিব ও পার্বতীর পুত্র রূপে। দেবলোকে যেখানেই যুদ্ধ হয় সেখানেই কার্তিকের ডাক পড়ে।
পুরাণ অনুসারে হলুদবর্ণের কার্তিকের ছটি মাথা। তাই তাঁর অপর নাম ষড়ানন। যুদ্ধের দেবতা বলে নাকি তাঁর ছটি মাথা। চারিদিক থেকে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাত চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। । তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক।
আবার কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম(কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ(লালসা),মদ(অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন। এই ষড়রিপু মানুষের জীবনের অগ্রগতির বাধা তাই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলেও কার্তিকের মত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে । তাই মাদুর্গার যুদ্ধযাত্রায় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গী না হয়ে যায় কোথায় !
বলতো কেন কার্তিকের বাহন ময়ূর?

কার্তিকের বাহন আমাদের জাতীয় পাখী আলস্যহীন ময়ূর । ময়ূরের পায়ে একটি সাপ অর্থাত অহংবোধ ও কামনা বাসনা বলি দিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। ময়ূর অত্যন্ত সজাগ এবং কর্মচঞ্চল পাখী । সৈনিক কার্তিকের সবগুণগুলি সে বহন করে ।
কোনো কোনো মতে রণ-দেবতা কার্তিক হলেন আকুমার ব্রহ্মচারী। আবার কোনো কোনো পুরাণ মতে কার্তিকের পত্নী হলেন ইন্দ্রের কন্যা দেবসেনা বা লক্ষ্মীরূপিণী ষষ্ঠী।
তাঁর নাম কার্তিক কেন ?
কৃত্তিকা নক্ষত্রে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং ছয় কৃত্তিকার দ্বারা তিনি পুত্ররূপে গৃহীত ও প্রতিপালিত হন বলে তাঁর নাম কার্তিকেয় বা কার্তিক। তাঁর আরো অনেক নাম আছে যেমন গুহ, পাবকি, মহাসেন, ষন্মুখ,কুমার, কুমারেশ, গাঙ্গেয়, বিশাখ, মহাসেন, কুক্কুটধ্বজ, নৈগমেয়।
কেন তাঁকে আমরা পুজো করি জানো?
ব্রহ্মার বরে মহাবলী তারকাসুরের নিধনের জন্যই নাকি অমিতবিক্রম যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। কেউ বধ করতে পারছিলনা তারকাসুরকে। তার অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ঠ । আর দৈববলে অজেয় শক্তি সম্পন্ন এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেছিলেন ।
আর এই তারকাসুর নিধন করে দেবকুলে কার্তিক গেলেন দেবসেনাপতি। তাই কার্তিকের পুজো হয় মহাসমারোহে।
দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। আমাদের জাতীয় যাদুঘরে ( ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে) বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর ভারতে কার্তিকের প্রভাব কমে আসে। আরাধ্য দেবতা রূপে কার্তিক উত্তর ভারতীয়দের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতে। তামিলদের কাছে তিনি মুরুগন নামে, আর অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকে তনি সুব্রহ্মণ্য নামের পুজিত হন। তামিলদের কাছে মুরুগন প্রধান আরাধ্য দেবতাদের মধ্যে একজন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে যেখানেই তামিলদের সংখ্যা বেশি, যেমন শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস- সেখানেই মুরুগন পরিচিত এবং সাড়ম্বরে পুজিত হন।
আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে কার্তিক ঠাকুর পুজো নিয়ে খুব বেশি হইহুল্লোড় হয় না। দুর্গাপুজোর পরেপরেই কিছুদিনের মধ্যেই কার্তিকমাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকের পুজো। কোন কোন প্রাচীন পরিবারে ধারাবাহিকভাবে, এবং এক-দুটি বিশেষ অঞ্চলে খুব হইচই করে এই পুজো হয়; কিন্তু সর্বজনীন পুজো হিসাবে কার্তিকপুজো বাঙালি সমাজে এখন আর সেরকম জনপ্রিয় নয়।
সেই কমে আসা উৎসাহ থেকেই সম্ভবতঃ মুখে মুখে তৈরি হয়েছে এই ছড়া -

"কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা,
একবার আসেন মায়ের সাথে,
একবার আসেন একলা।"

এটা কিন্তু খুব অন্যায়। একলা কার্তিকই খালি দুবার আসেন নাকি? মা-দুর্গার বাকি ছেলেমেয়েরাও কি আলাদা করে আরেকবার আসেন না?



ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত 

১৪ ডিসে, ২০১৪

আমার শারদীয়া ২০১৪

১৭ নভে, ২০১৪

কার্তিক কান্ড!

কার্তিক কান্ড!
তারকাসুরের অত্যাচারে সমগ্র দেবকুল অতিষ্ঠ। কে বধিবে তারে? দরকার হল অমিত পরাক্রমশালী এক যোদ্ধার যে কিনা অনায়াসে বধ করবে তাকে এবং দেবতাদের রক্ষা করবে।
ব্রহ্মার আদেশ মাথায় নিয়ে ভোলাবাবা পার্বতীকে নিয়ে মহাসুখে দরজায় খিল আঁটলেন। চলতে লাগল সম্ভোগ পর্ব। ওদিকে হর-গৌরীর বিলম্বিত রতিক্রিয়ায় অধৈর্য হয়ে দেবগণ মদনদেবকে প্রথমে পাঠালেন তাদের বেডরুমে তলব করতে। ভোলেবাবা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে মদনকে বাণ মেরে ভস্মীভূত করলেন। আবারো দরজায় খিল। এবার পাঠানো হল অগ্নিকে। শিবের অবস্থা তখন নালে-ঝোলে। পার্বতীকে ইমপ্রেগনেট করা তো দূরের কথা মৈথুনরত শিবের রেতঃ স্খলিত হল অগ্নির সম্মুখে। অগ্নি তা নিয়ে গঙ্গায় ফেলে এলেন।
এবার সেখান থেকে দেবশিশু স্কন্দের জন্ম হল। তাই গঙ্গা হল কার্তিকের জন্মদাত্রী জননী।
এবার কে দেখবে এই সদ্যোজাতকে?গঙ্গার তো অবৈধ শিশু কার্তিক। উপায় ও হল সাথে সাথে.... ছ'জন কৃত্তিকা, মানে আয়ার সমতুল্য ঐ শিশুকে স্তন্যদান করে পালন করতে লাগলেন। পার্বতী জানতে পেরে রেগে অগ্নিশর্মা।ছেলে বলে কথা!!! যেহেতু ঐ পুত্র শিবের ঔরসজাত ঐ পুত্রের মা হবেন তিনিই । তাই তো মাদুর্গা না বিইয়ে কানাইয়ের থুড়ি "কার্তিকের মা" হয়ে গেলেন। আর তারকাসুর বধ করে ফেমাস হয়ে গেলেন দেবসেনাপতি বা দেবলোকের আর্মির মেজর জেনারেল ।
টেকনিক্যালি গঙ্গার গর্ভে জন্ম তাই কার্তিকের এক নাম গাঙ্গেয়। থিওরিটিকালি কৃত্তিকারা মায়ের মত পালন করেছিল তাই আরেক নাম কার্তিকেয় ।
আর বেসিকালি মহাদেবের পুত্র তাই আরেক নাম শিবসুত ।
( abridged মত্স্যপুরাণ )

৬ নভে, ২০১৪

রাস, c/o ভাগবত

রাস, c/o ভাগবত
আমাদের জীবন তো একটা রঙ্গমঞ্চ। সেখানে আমরা আসি, দেখি, জয় করি, চলে যাই। রাসলীলা কিছুটা তেমনি। বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটি গুঢ় অর্থ বহন করে। 'রস' থেকেই রাস কথাটির উত্‍পত্তি। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, আহ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরেই পালিত হয় রাস উত্‍‌সব। এই কারণে কার্তিক পূর্ণিমার অপর নাম রাস পূর্ণিমা।শ্রীকৃষ্ণ কার্তিক পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনে যমুনার তীরে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাঁদের বিশ্বাস ও ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত ও ভগবানের মিলন উৎসব।পৌরাণিক মতে একজন নট যখন বহু নটীর সঙ্গে নৃত্য করেন তখন সেই যৌথ নৃত্যই  “রাস নৃত্য” বলা হয় । রাসে জীবাত্মা আর পরমাত্মার মিলন ঘটেছিলো । শ্রীকৃষ্ণ হলেন পূর্ণব্রহ্ম পরমাত্মা আর গোপিনীগণ জীবাত্মা । জীবাত্মা যখন পরমাত্মায় মিশে যায় তখন সেটাই হয় “মহারাস” । এইসব জটিল তত্ত্বের সাক্ষাৎ প্রতিভূই  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের “রাসলীলা”। 
"তোমরা আমাকে ভালোবাসা দাও, আমি তোমাদের ভালোবাসা দেব" এমনটিই বুঝি ছিল কৃষ্ণের মহামন্ত্র। গোপিনীদের সঙ্গে তাঁর আবাল্য সখ্য, একান্ত নিবিড় সম্পর্ক...গোপবালারা এক সে বড় কর এক সুন্দরী, অদ্বিতীয়া প্রেমিকা আর সারাক্ষণ কৃষ্ণপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বৃন্দাবনের কিছু রমণী। যারা ভক্তিযোগে তাঁদের কানুকে পাবার জন্য আমরণ চেষ্টা করে গেছেন। রাধার সঙ্গে  কানুর পিরীতি তাদের বুকে শেল হয়ে বাজত। রাধা একাই কেন পাবে কৃষ্ণকে? তাদের যুগলে দেখতে পেলে ঝলসে যেত গোপিনীদের চোখ, ফেটে যেত বুক। এহেন কূটনৈতিক কানু যাদবের চিন্তা হল। এত কষ্টের তৈরী ব্র্যান্ড। যুগে যুগে সেই ব্র্যান্ডকে বাজিয়েই চলেছে আম আদমী। কিন্তু বৃন্দাবনের গোপিনীরা কানুর পিরীতি থেকে বঞ্চিত থেকে যদি সেই আদি অনন্ত দুধ সাদা ব্র্যান্ডে কালি ছিটিয়ে দেয়? অগত্যা মধুসূদন। কানু যাদব ফন্দী আঁটলেন। শারদীয়া উত্সবের পরপর আম আদমীর মনখারাপ থাকে।গোপিনীদেরো ঘরের কাজকর্মে একটু ঢিলাঢালা ভাব থাকে। উত্সবের হ্যাঙ ওভার কাটতে না কাটতেই কার্তিকের পূর্ণিমায় আয়োজন করবেন রাস উত্সব... এই ছিল বুঝি প্ল্যান। তিনিই স্বয়ং ইভেন্ট ম্যানেজার। c/o ভাগবত !
অতএব সতীলক্ষ্মী সব গোপিনীদের সঙ্গে কানুদার একান্তে গেট টুগেদার হল রাসলীলা। আর তাই তো কানুদা হলেন রাসবিহারী। এ হল দ্বাপরের বেত্তান্ত। তারপর কলিতেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। বৃন্দাবনের আনাচেকানাচে কানুগত প্রাণ গোপিনীদের হৃদয়যন্ত্রে সেদিন বেজে উঠেছিল ভালোবাসার সেই সুর যা ৫০০০ বছর বাদেও  হৃদয়ঙ্গম করছেন সারা দেশের মানুষ। কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবন বিলাসিনী রাইয়ের একটু বেশিই ঘনিষ্ঠতাই নাহয় ছিল তাই বলে কৃষ্ণের দাপুটে ব্র্যান্ডে কেউ কালি ছেটাতে পারেনি। 
ঠিক যে মূহুর্তে গোপিনীরা "নাহ্‌, ঐ বাঁশী শুনে আর কাজ নাই" ভাবল তখনি কানুদা রাসলীলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলেন। মানে একপ্রকার গোপিনীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই বসলেন বিচক্ষণ কানুদা। আগে বাজাতেন ভৈরবী, ইমন, শুদ্ধ বিলাবল, ভূপালী এইসব রাগ-রাগিনী। এখন বাজালেন আহির ভৈরব, পুরিয়া ধ্যানেশ্রী, আশাবরী ...যত করুণ রসে সিঞ্চিত সুরের ঝর্ণা তত‌ই পাগলপ্রায় গোপিনীদের অবস্থা। অভিসারের কথা না জানিয়েই ছুটে যেতে ইচ্ছে হল প্রাণ। সবকিছু দিতে ইচ্ছে হল কানু-দয়িতের জন্যে।
কেউ তখন দুধ দুইছিল, কেউ দুধ জ্বাল দিচ্ছিল, কেউ রাঁধছিল খিচুড়ি। কেউ নিজের সন্তানকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। কেউ স্বামীকে দফতরে পাঠানোর জন্য দেখভাল করছিল। যে যেমন অবস্থায় ছিল ঠিক তেমন অবস্থায় সবকিছু ফেলে রেখে ছুটল সেই বাঁশীর পিছুপিছু।
"কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মন-প্রাণ"
একজন গোপিনী স্নানের পর চন্দন দিয়ে অঙ্গরাগ করতে ব্যস্ত ছিল। একজন পরছিল কাজল। একজন সবেমাত্র কাঁচুলি পরেছে, ভুলে গেল উত্তরীয় পরিধানের কথা। একজন আবার এক কানে কুন্ডল পরেই দৌড়ল। "উথালিপাথালি ওদের বুক, মনেতে নাই সুখ রে, আমায় ডুবাইলি রে , আমায় ভাসাইলি রে"
লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে কানুর কুঞ্জবন রূপ বৈঠকখানায় ছুটল তারা।
চুলোয় যাক্‌ সংসার! রসাতলে যাক স্বামী-পুত্র! "রইতে নারে, বাঁশীতে ডেকেছে যারে"
বাঁশীওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়েও বিপদ হল গোপিনীদের। কানু বাঁশীওয়ালা পরীক্ষা নেন সতত‌ই। গোপিনীরা পূর্ণিমার রজতশুভ্র জ্যোত্স্নায় বৃন্দাবনের কুঞ্জে এসেছে সব ছেড়েছুড়ে। এর মধ্যে কে কানুকে সত্যি ভালোবাসে আর কে লোক দেখানো সেটা যাচাই করতে তিনি বললেন, ভয়ঙ্কর রাতে, বনে বাদাড়ে হিংস্র বন্যপ্রাণী আছে। অতএব তোমরা ঘরে ফিরে যাও। গোপিনীরা বলল, চাঁদের আলোয় আঁধার তো দিন হয়েছে আর বৃন্দাবনের জন্তু জানোয়ার বন্ধুপূর্ণ অতএব আমরা আজ ফিরবনা এরাতে। কানুদা আবারো বললেন, তোমাদের পরিবারের লোকেরা কি বলবে? তাদের অহেতুক চিন্তা বাড়িওনা। কিন্তু গোপিনীরা নারাজ। "রহিল মোর ও ঘর দুয়ার".... কেষ্টারে লয়েই থাকবেন তেনারা।
নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগল" আজ সব ছেড়ে চলে এলাম তার জন্যে, আর এখন কিনা তিনি বলছেন ফিরে যেতে?" এদিকে প্রেমের অনুঘটক রূপে কাজ করল কার্তিকের মৃদুমন্দ হিমেল বাতাস, আকাশে রূপোর থালার মত পূর্ণচন্দ্র, আর ভেসে এল নানা ফুলের গন্ধ।
দিশেহারা হয়ে গেল সতীলক্ষ্মী গোপিনীরা। তন্ময় হয়ে গেল কানুচিন্তায়। ভুলে গেল দেহ-গেহ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারা একদৃষ্টে চেয়ে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেল একে একে। কানুর রূপ, বাঁশীর সুর, প্রেমের অনুকূল প্রকৃতি সবকিছু মিলেমিশে একাকার তখন। তাদের পরপুরুষের হাবভাব, চালচলন, চটূল হাসি, অকপট অনুরাগ, মধুর বাক্যালাপ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগে ব্যস্ত তারা।
"ভিতর বাহিরে, অন্তর-অন্তরে আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে"
তারা যারপরনাই হারিয়ে ফেলল নিজ নিজ পৃথক সত্ত্বা। প্রগাঢ় প্রেমে বুঝি এমনটিই হয়ে থাকে। পাগলপ্রায় গোপিনীরা উচ্চৈস্বরে গাইতে লাগল গান... "হরিনাম লিখে দিও অঙ্গে"

কানুর দুষ্টুমি শুরু হল তখন। অশোক, নাগকেশর, চাঁপা গাছের আড়ালে চলে গিয়ে পরখ করতে লাগলেন তাদের প্রেমের আকুতি। লুকোচুরি চলল কিছুক্ষণ। কানুর প্রিয় ছোট ছোট ফুলগাছ, কুর্চি, মালতী, জাতি। এদের কাছে গিয়ে গোপিনীরা জিগেস করল তারা... কানুকে দেখেছ ?
এভাবে চলল কিছুক্ষণ। অবশেষে বৃন্দাবনের তরুলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তারা লক্ষ্য করল কানুর খালিপায়ের ছাপ। ওরা ভাবল আবারো বুঝি কানু সেই রাধার সাথে দেখা করতে চলে গেছে। খুব অভিমান হল তাদের। হঠাত তারা দেখল কিছুদূরেই রাধা মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে। তা দেখে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল গোপিনীদের। সখীদের সেবায় রাধার জ্ঞান ফিরল। তাকে নিয়ে গোপিনীরা চাঁদের আলোয় যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় ততদূর গেল। তন্ন তন্ন করে খুঁজল কানুকে। তবু তার দেখা নাইরে। তার দেখা নাই। তারপর কানুর স্তুতি শুরু হল।
তারপর কিছুটা মান-অভিমানের পালা। যার জন্য আমাদের সব ছেড়ে চলে আসা, যার বাঁশীর শব্দে আকৃষ্ট হয়ে আমরা এই গভীর বনে চলে এলাম, যার কষ্টে আমরা এতদিন কষ্ট পেলাম, যাকে ভালোবেসে আমরা সকলের কাছে খারাপ হলাম সেই কানু কিনা আমাদের বুঝলনা? অতএব কানু একজন শঠ ব্যক্তি। তিনি মিথ্যাচার করেছেন। তিনি কপট। কানু বেচারা তখনো ইনভিজিলেটরের ভূমিকায়। পরীক্ষা তিনি নিয়েই চলেছেন।
আচমকা অতর্কিতে কানু বেরিয়ে এলেন বনের মধ্যে থেকে। গলায় বনমালা আর পরণে পীতাম্বর পট্টবস্ত্র। আকস্মিক মৃত সঞ্জীবনীর কাজ হল। গোপিনীরা প্রাণ ফিরে পেলেন যেন। এবার শুরু প্রকৃত লীলার ।
সংস্কৃত গোপী শব্দটির অর্থ হল রাখালি বালিকা যাঁরা গো-সেবা করেন। কেউ বলেন গোপিনী, কেউ আবার বলেন গোপীকা। এঁরা হলেন ভক্তিমার্গে বিচরণকারী ব্রজের রমণী। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন কৃষ্ণের একশো আটজন সখী...এঁরা হলেন বৃহত্তর বলয়ের নিবিড় সাথী... চন্দ্রাবলী এঁদের মধ্যে অন্যতম। আরো নিবিড়তর বলয়ের অষ্টসখী হলেন চম্পকলতা, চিত্রা, ইন্দুলেখা ,রঙ্গদেবী, সুদেবী, তুঙ্গবিদ্যা, ললিতা, বিশাখা.......। আর সবচেয়ে কাছের এবং অন্যতমা হলেন শ্রীরাধিকা। শ্রীকৃষ্ণচরিতামৃত অনুযায়ী সব মিলিয়ে বৃন্দাবনে তখন কৃষ্ণের সাথে ষোলোহাজার গোপিনী সঙ্গ করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দূত ছিলেন তাদের প্রভুর। কেউ কেউ ছিলেন পরিচারিকা বা সেবাদাসী।
শ্যামলী তার চন্দনচর্চিত বাহুদুটি দিয়ে কানুকে জড়িয়ে ধরল। চন্দ্রাবলী বিনয়ের সাথে হাতজোড় করে প্রেমের পরিচয় দিল। শৈব্যা অঞ্জলিপুটে কানুর চর্বিত পান গ্রহণ করল।পদ্মাবতী নিজের বুকের মধ্যে কানুর চরণযুগল রাখল । ললিতা অনিমেষ নয়নে কানুর শ্রীমুখ দর্শন করতে করতে বিহ্বল হয়ে পড়ল। বিশাখা কানুকে নিজের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করে চোখ বুঁজে পরম তৃপ্তি লাভ করল। আর যে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে কানু আমার, আমি কানুর ন‌ই সেই রাধিকা অভিমানে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। বৃন্দার কানুকে দেখে পাগলপ্রায় অবস্থা। বিদ্যুত্লতার মত দেহবল্লরী নিয়ে চম্পকলতা স্থানুবত দাঁড়িয়েই র‌ইল। কখন প্রভু কৃপা করে তার হাতটা ধরবেন একটু! একটু হবে স্পর্শসুখ। বহু প্রতিক্ষীত একটুকু ছোঁয়া লাগা স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাবেন আবার গৃহকাজে।
অতঃপর প্রাণে খুশীর জোয়ার এল। কেঁপে কেঁপে উঠল গোপবালারা। সায় দিয়েছে কানুর মন। বিরহের অবসান হল। দেবতারা বিমানে চড়ে উপস্থৈত হলেন স্বর্গলোকে। পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। দুন্দুভি বেজে উঠল। রাসমন্ডল শতশত ব্রজবালার নূপুরের সিঞ্জিনী, বলয়ের কিঙ্কিনীতে তোলপাড় হতে লাগল। এ যেন এক স্বর্গীয় লীলাখেলা। সকল গোপিনীরাই অনুভব করল যে কানু তাদের দুহাত দিয়ে কন্ঠ আলিঙ্গন করছেন। নিজের মহিমাবলে কানু তখন একই অঙ্গে বহুকৃষ্ণে লীলা করতে লাগলেন তাদের সাথে। প্রত্যেকেই খুশি তখন। সম্মোহন শক্তিতে আপ্লুত তারা। সকলের মনে হল কৃষ্ণ শুধু তার্, আর কারো নয়। নিজের নিজের কাছে প্রিয়তমকে দেখে সকলেই উদ্বেলিত তখন। ব্রজবালারা কটিবন্ধের চাদর কষে বেঁধে নিলেন। কঙ্কন-বলয়ে রোল তুলে, মল-নূপুর, বিছুয়া বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য করতে লাগলেন সেই একমেবাদ্বিতীয় কৃষ্ণকে ঘিরে। গাইতে লাগলেন শ্রুতিমধুর গান। কানু নিজের গলা থেকে মল্লিকাফুলের মালা ছুঁড়ে দিলেন গোপিনীদের দিকে। দীর্ঘায়ত হল সে রাত। নক্ষত্রমন্ডল রাস দেখতে দেখতে বিস্মৃত হল অস্ত যেতে।
এখন আমাদের প্রশ্ন হল শ্রীকৃষ্ণ কেন পরস্ত্রীদের সঙ্গে এহেন পরকীয়ায় লিপ্ত হলেন? আদৌ কি এ পরকীয়া প্রেম না কি অন্যকিছু? না কি দেবতা বলে তাঁর সাতখুন মাপ? ভাগবত অনুযায়ী তিনি মায়ায় বশ করেছিলেন। নিজের সঙ্গেই নিজে খেলা করেছেন। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাঁকে একান্ত আপনার করে পেতে চায় তাঁর সাথে তিনি এমন লীলাই করেন। গোপবালারা উপলক্ষ্য মাত্র। শ্রীধর স্বামী তো বলেইছেন
"রাসলীলায় শৃঙ্গাররস ছলনামাত্র। আসলে এই লীলা মুক্তিপ্রদায়িনী।" আর তাই তো তিনি এখনো বৃন্দাবন তথা সমগ্র বিশ্বের একমেবাদ্বিতীয় ব্র্যান্ড এম্বাস্যাডার!!!

আর মহামিলনের জন্য‌ই কি এমন ঢালাও আয়োজন চলে আসছে প্রত্যেক পূর্ণিমা তিথিতে ? ঠিক তাই। বছরের তিনটে বিশেষ পূর্ণিমাতে হয় রাধাকৃষ্ণের তিন লীলা-উত্সব বা যাত্রা । ফাল্গুণী পূর্ণিমায় দোলযাত্রা, শ্রাবণী পূর্ণিমায় ঝুলনযাত্রা আর কার্তিক পূর্ণিমায়  রাসযাত্রা। আর এই  মিলনোৎসবে আজও কেন সামিল হাজার হাজার মানুষ ? বছরের এই বিশেষ দিনগুলোতে তিথিক্ষণ মেনে কেন আমরা এখনো জমায়েত হ‌ই মেলা প্রাঙ্গণে?
আর কেন‌ই বা ঝুলনযাত্রার শেষে রাখী বেঁধে দিয়ে মিষ্টিমুখ করায় আমার বন্ধু ? রাধাকৃষ্ণ, ঝুলন সাজানো, এসব তো মানুষের মনগড়া । আসল তো মাঝেমাঝে সম্পর্কটাকে ঝালিয়ে নেওয়া। কৃষ্ণ স্বয়ং সেকথাও বুঝেছিলেন। হঠাত হঠাত মথুরা থেকে বৃন্দাবন, সেখান থেকে দ্বারকা ...তাঁর সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক  সদাব্যস্ত কর্মসূচীর টানাপোড়েনে  শ্রীরাধার সাথে সম্পর্কটা যায় যায় হয়ে দাঁড়াতো। তাই তো এই উতসবের মধ্যে দিয়ে আবারো মধুর সম্পর্কটা টিঁকিয়ে রাখার চেষ্ট করে যাওয়া। একান্তে দিনকয়েক কাছের করে পাওয়া। দুজনের কত শৃঙ্গার, ভৃঙ্গারে  গল্পমুখর দিনরাত এক হয়ে যাওয়া।


৩১ অক্টো, ২০১৪

জগত্+ধাত্রী == জগদ্ধ্বাত্রী

মেয়ে যুদ্ধ করে জিতে এয়েচে, মানে দশহাতে অসুর বধ করেচে, দেশ জুড়ে সবাই মেয়েটাকে বাহবা দিতেছে.... মাদুগ্গা কৈলাসে ফিরে গেচেন মাস খানেক হল। দেবতারা বসে সেখানে গোঁফে তা দিতেছেন।
একা মেয়েছেলের কত ক্ষেমতা বাপু, কেষ্টদা অকপটে মেনে নিল।
কেউ বলছে, ধুস্‌ তবুও যদি বুঝতুম একা সামলেছে সব।
ধার করা সব অস্ত্র শস্ত্র পেলে আমারাও অমন দশটা অসুর মারতে পারতি, ইন্দর দাদাবাবুতো কোনো রাখঢাক নেই, বলেই ফেল্ল।  
তবে যাই বলো বাপু দুগ্গাটা দেকিয়ে দিল! শিবুদা বৌয়ের প্রশংসায় আরো কয়েক ছিলিম বেশী গাঁজা নিয়েছে ।
এখন কৈলাসে মহিষাসুর বধের দ্বিতীয় ইনিংসের তোড়জোড়। বড়াখানার আয়োজন হচ্ছে। দুর্গার অনারে। তবে অহংকারে পা পড়তেচেনা কারো। যেন তেনারাই যুদ্ধ করে এয়েচেন। তাই দেখে শুনে শিবুদা বললেন তা তোমাদের বৌয়েরা তো সব পাটরাণী। বলি আমার বৌ অসুর মেরেচে তো তোমাদের এত গর্বের কি! এমন ভাবখানা কচ্চো যেন তোমরাই মেরেচো!
ব্রহ্মা সেই শুনে একটা ফন্দী আঁটলেন। ব্রাহ্মণের রূপ ধরে রাজসভায় এসে সকলের সামনে একটা তৃণ মানে কচি দুব্বোঘাসের টুকরো রেখে বললেন, দেখি কত্ত ক্ষেমতা বাপু তোমাদের্? এই তৃনটাকে উড়িয়ে দাওতো যেমন করেই হোক!
পবনদেব এলেন। বললেন্, এ আর এমন কি! কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারলেন না ঐ ঘাসের টুকরোকে হটাতে। এরপর অগ্নিদেব এলেন তৃণকে পুড়িয়ে দেবার জন্যে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও বিফল হলেন।
তখন ব্রহ্মা স্বয়ং নিজের রূপ ধরে বল্লেন, কি করে পারবে তোমরা? সারাটা জগতকে যিনি ধারণ করে রয়েছেন তিনিই তো মায়া-মমতা-স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন ঐ তৃণটুকুনিকে। অতএব স্বীকার করলে তো ঐ জগদ্ধ্বাত্রীর কত্ত ক্ষেমতা? আর তোমরা কিনা দুর্গার অসুরবধ নিয়ে বুক ফোলাচ্ছ্, গোঁফে তা দিছ, পার্টির আয়োজন কচ্চো যেন তোমরাই অসুরটাকে মেরেচো!!!

অতএব এখন দুর্গা=জগদ্ধ্বাত্রীর অনারে আরো একবার পার্টি হৌক্! কেষ্টদা বলে উঠলেন!!!  

২২ অক্টো, ২০১৪

প্রাক্‌-কালীপুজো কথন


কোজাগরীর ঘোর কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর পরদিনেই ভূতচতুর্দশী। শুক্লপক্ষে আকাশ আলো করা রূপোর থালার মত চাঁদ, হিম ঝরানো জ্যোত্স্না আর শারদীয়ার মনখারাপ। দিন পনেরো কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণপক্ষের সূচনা। ভূত চতুর্দশীর প্রস্তুতি। আমেরিকার হ্যালোউইন আর ভারতবর্ষের আকাশ প্রদীপ জ্বলা ভূত চতুর্দশীর ঘোর অন্ধকার। সেই পূর্ণিমার চাঁদ এখন ঘুমোতে গেছে। ঝুপসি অন্ধকার আকাশের গায়ে। শহরে অবিশ্যি আসন্ন দীপাবলীর আলোর রোশনাই আর আকাশছোঁয়া ঘরবাড়ির আলোয়, বাজির গন্ধকী গন্ধে ভরপুর বাতাস। হিমের পরশ, ঝিমধরা নেশাগ্রস্ত ... ঋতু বৈচিত্র্যময়তায় । কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী। আকাশের ফুটফুটে তারা সেই অন্ধকারে দৃষ্টিগোচর হয়। হ্যালোউইন পালিত হয় সেদেশে মৃত আত্মার শান্তি কামনায়। ঠিক যেমন আমরা আমাদের মহলায়ায় প্রিয়জনের মৃত আত্মার প্রতি স্মৃতিতর্পণ জানিয়ে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের শুরু করি। 
 মহালয়ার দিনে আমরা যে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে  তাঁদের মর্ত্যে অবতরণ ঘটিয়েছিলাম । ঠিক একমাস পরের অমাবস্যায় তাঁদের আবার স্বর্গে ফিরে যাবার কথা। তাঁদের যাত্রাপথকে আলো দেখানোর জন্য এই একমাস আকাশপ্রদীপ জ্বলেছে প্রতিবাড়ির ছাদে। এবার তাঁদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য দীপাবলী উত্সব। তাঁরা আবারো শান্তিতে  আলোয় আলোয় ফিরে যাবেন স্বর্গলোকে।   

ভূত চতুর্দশীর অন্ধকারে মৃত আত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়। তাদের আত্মার শান্তি কামনায় চৌদ্দ রকম শাক (ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাটঁপাতা, সুষণী ) ভেজে খাওয়ার রীতি। আর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির আনাচে কানাচে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালার নিয়ম। কোথাও যেন কোনো অন্ধকার না থাকে। বৈদিক মতে এর ঠিক একমাস আগে মহালয়ার দিন পরিবারের আত্মীয় বন্ধুদের মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে তর্পণ করা হয় তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। আবার তন্ত্র মতে ঠিক এক মাস পরে এই কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন মৃত আত্মাদের আলো জ্বালিয়ে স্মরণ করা হয়। মূল কথা একটাই ,তোমরা সুখে থাকো, ভালো থাকো। কারো কোনো অনিষ্ট কোরোনা। 

ছবিঃ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

পুরাণকথায় পাই দেবী কালী নাকি কার্তিকমাসের এই চতুর্দশীর রাতে ভয়ানক অত্যাচারী নরকাসুরকে বধ করেন। তাই তামিলনাডুতে এই চতুর্দশীর রাতেই দীপাবলি পালিত হয়। কিন্তু অন্য সব রাজ্যে পরের দিন অর্থাত অমাবস্যার রাতেই কালীপুজো হয়। গোয়ায় নরকাসুরের কুশপুত্তলি পোড়ানো হয় মহা সমারোহে। কাগজের তৈরী এই কুশপুতুলে নানারকম বাজি বেঁধে তাতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালানি হয়। কারণ কিংবদন্তীর কড়চা বলে গোমন্তেশ্বর বা গোয়াতেই নাকি নরকাসুরের দাপট অতিবৃদ্ধির জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তা রুখতে সেখানে হাজির হন সুদর্শন চক্র সমেত। তবে নরকাসুর বলি হন মা কালীর হাতে।
গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র উত্তরপ্রদেশ সহ সর্বত্র দেওয়ালী পালন করা হয় আলোর উত্সব, ধনতেরস ইত্যাদির সাথে । আত্মীয় বন্ধুদের সাথে উপহার আদানপ্রদান হয়, মোমবাতি, প্রদীপের আলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়।
দক্ষিণ ভারতে যেমন নরকাসুর বধের আনন্দোত্সব হল দীপাবলী উত্তর ভারতে রামচন্দ্রের রাবণ বধ করে অযোধ্যায় ফিরে আসার বিজয়োত্সব।আলো দিয়ে অযোধ্যা নগরীর কোণা কোণা সাজানো হয়েছিল। তাই আলোর উত্সব দীপাণ্বিতা বা দীপাবলী বা দেওয়ালি। মূল কথা আলো আর তাকে কেন্দ্র করেই নতুন পোষাক, সুখাদ্য আর উপহার আদানপ্রদান। সেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা, কামরূপ থেকে কাথিয়াবাড় সর্বত্রই অশুভ শক্তির বিনাশ আর শুভ শক্তির বরণোত্সব হল দীপাবলীর মদ্যা কথা।
ধনাগমের জন্য মানুষ করে ধনতেরস ও লক্ষ্মী-গণেশের পুজো। মূল উদ্দেশ্য একটাই। শ্রীবৃদ্ধি আর উন্নতি। আলোয় আলোয় সব ঘুচে যাক্‌, মুছিয়ে দে মা মনের কালি।
পশ্চিমবাংলায় অনেকের রীতি কালীপুজোর বিকেলে দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপূজো করে অলক্ষ্মী বিদেয় করা হয় । সংসারে সারাবছর যাতে শ্রীবৃদ্ধি হয়, ধনাগম হয় সেই আশায় । লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরের পুজো হয় । পিটুলি বাটা দিয়ে মা তাঁর নিপুণ হাতে তৈরী করেন তিন পুতুল.... সিঁদুর দিয়ে পিটুলির তৈরী লালরঙের লক্ষ্মী পুতুল, নীলের গুঁড়ো দিয়ে নীল নারায়ণ পুতুল, আর অপরাজিতা পাতা বাটা দিয়ে সবুজ কুবের পুতুল । কলার পেটোতে সেই পুতুল তিনটিরই আসলে পূজো হয় ঐদিন । আর একটি কলার পেটোতে মাথা থেকে আঁচড়ানো চুলের নুড়ি, একটু গোবর আর একটা ভাঙা মোমবাতি রেখে তৈরী হয় অলক্ষী । চাটাই পিটিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে অলক্ষীকে বাড়ির বাইরে বের করে পূজো করে, লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।

চাটাই বাজাতে বাজাতে বলা হয়,

 " অলক্ষ্মী বিদেয় হোক, ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাক্" আসলে কুললক্ষ্মীর পুজো এই দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো। ........

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাত ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরস নামে উত্সব পালন হয় । পুরাণের গল্পে আছে সমুদ্রমন্থনের সময়কালীন এক গল্প। ঐশ্বর্যের ভারে অহংকারী দেবরাজ ইন্দ্র সকলকে খুব হেয় করছিলেন। একদিন দুর্বাশা মুনি তাঁর গলার পারিজাতের মালাটি অত্যন্ত স্নেহের সাথে হাতির পিঠে চড়া ইন্দ্রকে গলায় পরিয়ে দিতে যান। মালাটি ইন্দ্রের গলায় না পড়ে হাতির দাঁতের ওপর গিয়ে পড়ে ও হাতি ততক্ষণাত সেই মালাটিকে শুঁড়ে করে মাটিতে ফেলে দেয়। তা দেখে দুর্বাসা অতীব ক্রুদ্ধ হন ও দেবরাজকে "লক্ষ্মী চ্যুত হও" এই বলে অভিশম্পাত করেন। মুনির এই অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের পরাজয় লাভ করেন ও রাজ্য, সিংহাসন, লোকবল সব হারান। অসুররা তখন স্বর্গের মালিকানা পান ও লক্ষ্মীদেবী সহ সমগ্র দেবতাকুল পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের অতলে আশ্রয় নিলেন। দেবকুলের এহেন সমূহ বিপদে দেবরাজ ইন্দ্র প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তিনি সব শুনে বললেন একমাত্র বিষ্ণুই পারেন দেবতাদের বিপন্মুক্ত করতে। আর তখনি শুরু হল সেই মহাকার্য যার নাম সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রের গভীরে নাকি "অমৃত" নামে এক অমোঘ সঞ্জিবনী সুধা আছে যা পান করলে দেবতারা অমরত্ব লাভ করবেন। বিষ্ণুর আদেশে মন্দার পর্বত হল সমুদ্রমন্থনের দন্ড। আর নাগরাজ বাসুকী হল মন্থনের রজ্জু। মন্দার পর্বতকে বাসুকী তার সমগ্র শরীর দিয়ে বেষ্টন করে র‌ইল আর দেবতারা দুইদিক থেকে তার মুখ ও লেজ ধরে টানতে লাগলেন। শুরু হল ভয়ানক সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়া। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত নামে হস্তী, চন্দ্র, উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ব, বৈচিত্রময় মণিমাণিক্য, পারিজাত নামক স্বর্গের নান্দনিক পুষ্পবৃক্ষ সব উঠে আসতে লাগল একে একে । এরপর অমৃতের ভান্ড হাতে উঠলেন দেবতাদের চিকিত্সক ধ্বন্বন্তরী। আর সবশেষে বাসুকীরাজের সহস্র ফণারূপ ছত্র মাথায় উঠে এলেন মা লক্ষ্মী।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কার্তিকমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতেই সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন ধ্বন্বন্তরী। তাই এই তিথির নাম হল ধনতেরস। তাই এই দিনটিতে ধনের উপাসনা করতে হয়। আর তার ঠিক পরেপরেই লক্ষ্মীর পুজো করতে হয়। সমুদ্রের ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন মহালক্ষ্মী। সেদিন নাকি ছিল কার্তিক অমাবস্যা। তাই লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানটিতে আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়েছিল স্বর্গকে।

২৬ সেপ, ২০১৪

প্যাপিরাস পুজোসংখ্যা






মিশন সাকসেসফুল! মঙ্গল হি মঙ্গল! মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা !
তাই মঙ্গলযানের উপকক্ষপথে সফল প্রতিস্থাপনে প্যাপিরাসের পুজোসংখ্যার প্রকাশ! দেশ ও দশের মঙ্গলবার্তা পাথেয় হোক!

প্যাপিরাস ই-পত্রিকা পড়ুন এবং পড়ান। প্যাপিরাসের পাঠক এবং লেখক বন্ধুদের দুর্গাপুজোর জন্য অনেক শুভকামনা জানাই! 



১৪ আগ, ২০১৪

স্বাধীনতা ???

আমার স্বাধীন কলম  ৬৭ বছরের পুরোণো স্বাধীনতার পরেও  প্রতি মূহুর্তে প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে   ।
স্বাধীনদেশে জন্মেছি তাই ভাগ্যবতী কিন্তু প্রশ্নের জটগুলো ছিঁড়ে বেরোব কবে? বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে উল্লিখিত দেশমাতৃকা যাকে আমরা প্রণাম করে বলি "বন্দেমাতরম্‌"  !   সেই মা ছিলেন, আছেন ও থাকবেন  । কিন্তু কতটা ভালো থাকবেন আর কেমন করে আমাদের ভালো রাখবেন সেটাই হল প্রশ্ন । 
সেসময়  রক্তমাংসের মা ছিলেন ধূলোমুঠি শাড়িতে, কোলজুড়ে ছেলেপুলের বাত্সল্যে উথলে ওঠা নিপাট ঘরের বৌটি । সংসার সামলানো যার জীবনজুড়ে । ম্যাটিনি শোয়ের সিনেমা যার বিলাসিতা  আর সরাদিনের তেলহলুদ মাখা শাড়ি পরা হেঁশেল অন্তপ্রাণ । হাসিমুখে থোড়-বড়ি-ডাঁটার জঞ্জাল সামলাতে সিদ্ধহস্ত এহেন মা'টি  ছিলেন ঈষত লাজুক স্বভাবের ।
কালের চক্রে অবগুন্ঠনা মায়ের উত্তরণ ঘটল । মা অসূর্যম্পশ্যা থেকে আলোর মুখ দেখলেন । শিক্ষার ধারাপাত তাঁর হাতে । মুখে প্রচ্ছন্ন বুদ্ধিদীপ্ততা , চোখে উদ্ভাসিত উচ্চাকাঙ্খা । আধুনিকা তিনি আবার পুরাতনীও কিছুটা ।
আবার উত্তরণ এই মায়ের । আলোর দিশা নিজেতো দেখলেনই আবার পৃথিবীকেও দেখালেন ।
কিন্তু প্রাপ্য সম্মনটুকুনি কি আদায় করতে পারলেন সেই মা ?   আর তাই বুঝি আমাদের সমাজে মায়ের এত অবহেলা ? কন্যাভ্রূণের প্রতি অবিচার থেকে নারীপাচার, কিশোরী ধর্ষণ থেকে  স্বাধীনভাবে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হয় সেই মা'কে? আবার এই বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়
"বেকার হোমমেকার" "মা" টিকে ভিখারি, বারবণিতা, এবং বন্দীর সাথে একই আসনে রাখা হয় কারণ এরা সকলে "নন প্রোডাক্টিভ" পপুলেশনের আওতায় পড়ে ।  এই মা'র জন্য‌ই কেউ গিয়ে নাসায় রকেট চড়ছে, কেউ জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী করছে, কেউ বানাচ্ছে  অটোমোবাইল, কেউ বা হচ্ছে সৌরভ, লিয়েন্ডার-বিশ্বনাথনের মত  কিম্বা রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের মত নোবেল লরিয়েট অথবা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ আনছে মেরি কমের মত !  
তাই আমার অন্তঃসলিলা মনের ধারা বলে উঠলঃ

এই কি আমার স্বাধীনতা, যা বলে "উন্নত মম শির"
এই কি সেই স্বাধীনতা, সে তো পদ্মপাতায় নীর !
এই কি আমার স্বাধীনতা, না কি নিছক দেশপ্রেম ?
এই কি আমার স্বাধীনতা
যা তোমার আমার ভালোয় মন্দে রোদের কণায় হেম?

দূর থেকে সেই স্বাধীনতা আমরা উপভোগ করে যাব ? রোদের কণা যেমন ছোঁবার স্বাধীনতা আমাদের নেই ঠিক তেমনি?  

৭ আগ, ২০১৪

বাইশে শ্রাবণ

আজ অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে মানুষ যখন পরিবেশ সচেতনতার বাণী আওড়ায় তখন মনে হয় বাইশে শ্রাবণের কথা। মরণশীল রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণকে তার আশ্রমের বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে ধার্য করেছে বিশ্বভারতী। যেন তিনি ঐ উত্সবের মধ্যে দিয়ে নবজীবন লাভ করেন প্রতিবছর। ১৯৪২ সাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে অথচ বিষয়টির ওপর বিশেষ আলোকপাত দেখিনা। 

শ্রাবণের ধারায় সিক্ত মাটিতে উদ্ভিদ তার সঞ্জিবনী শক্তি পায় ও ধীরে ধীরে  মহীরুহে রূপান্তরিত হয়। তাই তার নবীন জীবন বরণের এই উত্সবে কবির গতজীবন স্মরণ-মননের এবং বৃক্ষের নবজীবন বরণের। শান্তিনিকেতনে বিগত এই এতগুলি বছর ধরে কত নামী মানুষের হাতে পোঁতা বৃক্ষের তালিকাসূচি পাওয়া যায় । শ্রাবণ যেন দিনের শেষে যেতে গিয়েও যেতে পারেনা। বাইশেও তাকে নতুন করে ফিরে পাওয়া আমাদের। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ছিন্নপত্রে তার উল্লেখ পাই আমরা। 

কবি বলছেন্" এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে যখন মাথাতুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি এই পৃথিবীর  নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাস গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম।"

 বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের সূচনা কবি প্রথম করেছিলেন তাঁর জন্মদিনে। আর কেন এই উত্সব সেই কারণ হিসেবে কবি বলেন" পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির ঊর্বরতার ভান্ডার নিঃস্ব হল।"

এই কথা মাথায় রেখেই বৃক্ষরোপণ বা বনমহোত্সব্ বা তাঁর ভাষায় " অপব্যায়ী সন্তান কতৃক মাতৃভান্ডার পূরণের কল্যাণ উত্সব"  

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কবির পরিবেশ বান্ধব মনের কোণে জেগে থাকা কত ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাঁর ইচ্ছেগুলোর সুবিচার হয়েও হয় নি। বিচারের বাণীগুলি নীরবে, নিভৃতে কেঁদেছে। সোনাঝুরির খালপাড়ে কত চাঁদ-সূয্যি উঠে অস্ত গেছে। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ থেকে ছাতিমতলা অবধি কত গৃহবাসী দ্বার খুলেছে। কত বসন্ত, কত পৌষ দেখেছে। গোয়ালপাড়া থেকে তালতোড়, ফুলডাঙা থেকে শ্যামবাটিতে কত জনসমাগম হয়েছে। খোয়াইহাটে কত কত কাঁথা বাটিকের পসরা সেজেছে। ভুবনডাঙায় কত টেরাকোটার ঢোলক, নোলক নাড়াচাড়া হয়েছে । কত আউল বাউল গাইল মন প্রাণ ঢেলে। হৃদমাঝারে তবুও ধরে রাখতে পারলনা তাদের কবিগুরুকে । একরত্তি কোপাইয়ে যে জল সেই জলই রয়ে গেল যেন। আজ তিনিও পণ্য। বসন্ত উৎসবে, পৌষ মেলায় তাঁকে বেশী করে স্মরণ, মনন, তাও নিজেদের স্বার্থে। বৃক্ষরোপণ আজও হয় বাইশে শ্রাবণে তবু আরও সবুজায়ন হয়েছে কি? শান্তিনিকেতনের চারিপাশে আবর্জনার দূষণ কমেছে কি? গুরুকুলে শিক্ষার মান বেড়েছে কি? বিশ্বভারতী তেমন করে আর কবির ঠাটঠমক ধরে রাখতে পারল কই? 


 তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন, আবদুস শাকুর ( দীপ প্রকাশন্ )