'আমাকে আমার মত থাকতে দাও...' - হ্যাঁ, এই কথাটা বেশ গম্ভীর গম্ভীর গলায় বলতেই পারে নতুন বঙ্গাব্দ - নেই নেই করে বাংলা চতুর্দশ শতক এইবার আঠেরোয় পা দিয়েই ফেলল যে ! আর কে না জানে, আঠেরো বছর বয়স মানেই বড় হয়ে যাওয়া, কাগজে কলমে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়া, হয়ত বা অনেক কিছু করার ছাড়পত্রও পাওয়া !
আঠেরো বছর আগে যখন বঙ্গাব্দ ১৪০০য় পা দিল, মনে আছে তখন নানান উতসব উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। হিসেব করে দেখতে গেলে, সেই আঠেরো বছর আগে আমি নিজেও আঠেরোর আশেপাশেই ছিলাম। মানসিক ভাবে কতটা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলাম তা আজ আর সত্যিই মনে নেই, কিন্তু কাগজে কলমে "বড়" হয়ে কোন একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথম বার ভোট দিয়ে এসে , বাঁ হাতের মধ্যমায় বেগুনী রঙের দাগটাকে দেখে দেখে বেশ কয়েকদিন যে খুব উত্তেজিত বোধ করেছিলাম তা বলতে পারি।
যদি ভাবতে বসি চতুর্দশ শতক আঠেরোয় পা দিয়ে কি করবে, তাহলে কেমন হয়? সত্যিই কি সে হয়ে উঠবে প্রাপ্তবয়স্ক? তার কাছ থেকে আমাদের কি কি আশা করার আছে? হয়ত নেহাতই কাকতালীয়, কিন্তু এটা ঘটনা যে আঠেরোয় পা দিয়েই চতুর্দশ শতক সম্মুখীন হতে চলেছে এক জমজমাট নির্বাচনের। কাকে জেতাবে সে, কে তার পছন্দ, এই নিয়ে নাহয় আর কথা নাই বা বাড়ালাম; হাজার হোক, সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক, তার ভাবনা চিন্তা পছন্দ তারই; সেখানে অন্য কেউ কথা না বলাই ভাল।
কিন্তু এছাড়া? আঠেরোয় পা দিলেই তো হল না, বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে এসে পড়ে কিছু দায়িত্ব, কিছু আশা পূরণের অংগীকার। বড় হয়ে গেছি, তাই 'আমাকে আমার মত থাকতে দাও...' বললেই কিন্তু সেই দায়িত্ব এড়ানো যায়না। সবাই যে যার নিজের মত থাকতে চায়, একে অন্যকে পরোয়া করে না, রাস্তায় একে অপরকে ধাক্কা মেরে চলে, যেখানে সেখানে থুতু আর পানের পিক ফেলে, যেমন ইচ্ছা তেমন করে গাড়ি চালায়, সিগনালের তোয়াক্কা না করে রাস্তা পার হতে গিয়ে আরো বেশি জ্যাম তৈরি করে, বেলাইনে গিয়ে কাজ সারতে চায়, নির্দ্বিধায় ঘুষ দেয় আর ঘুষ খায়, বেদম আলসেমি করে, কাজের জায়গায় অকাজ করে বেশি, তোমার দরজার সামনে নিজের বাড়ির নোংরা ফেলে যায়, অকারণে ঝগড়া করে, বিনাকারণে মন কষাকষি করে...১৪১৮'র কাছে যদি এই আশা রাখি যে সে এই সব কিছুকে বদলে দেবে, অন্তত চেষ্টা করবে - সে কি পারবে আমার এই আশাপূরণ করতে?
আমি জানি, যে কাজের ফিরিস্তি দিলাম, তা কারোর পক্ষেই একদিনে বা একলার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব নয়। আঠেরো বছরে পড়া চতুর্দশ শতক হয়ত তার এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে, ব্র্যান্ডেড জিন্স্ আর টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে, গুজরাতি কাজ করা স্লিং ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, কানে আইপড লাগিয়ে, তন্দুরি চিকেন ফ্লেভার্ড্ পিত্জায় কামড় দিয়ে, মোবাইল থেকে ফেসবুক আর অর্কুটে আপডেট পাঠাতে পাঠাতে আমার নাকের সামনে দিয়ে বলে চলে যাবে - "এইসব টু-ডু লিস্ট আমাকে ধরিও না, আমাকে আমার মত থাকতে দাও..."
কিন্তু আমি যে জানি, 'আঠেরো বছর বয়স জানেনা বাধা...' , তাই, আশা করতে তো আপত্তি নেই ! সেই আশায় বুক বেঁধেই নাহয় আরো একবার বাংলা সনের জন্মদিন পালন করব আমরা - প্রভাতফেরি হবে, বাংলা - বাংলা ভাষা- বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে নানাধরনের উতসব-অনুষ্ঠান- আলোচনা হবে, পেটপুরে বাড়িতে- রেস্তোঁরায় খেতে-ভুলে-যাওয়া-কচুর শাক বা রাঁধতে-কঠিন-চিতল মাছের মুইঠ্যা খাওয়া হবে, নতুন কাপড়ের পাট ভাঙা হবে, হালখাতা হবে... স-অ-অ-ব হবে, প্রতি বছর যেমন হয়। কিন্তু তারপরে?
ইংরেজি নববর্ষের মত হইচই করে বাংলা নতুন বছরে 'রেসোলিউশন' নেওয়ার অভ্যাস হয়ত আমাদের নেই, কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি -এই বছরে আমাদের সবার মনে আসুক আরেকটু দায়িত্ববোধ, আসুন নতুন বছরের হাত ধরে শিখে নিই আর শিখিয়ে দিই কেমন করে আরেকটু ভালভাবে বাঁচতে হয়।
সূর্যের প্রখর দাবদাহে তপ্ত গ্রীষ্মের দুপুরে কখন হটাত করে ধেয়ে আসবে সব ওলটপালট করা প্রাণজোড়ানো কালবৈশাখী - আগে থেকে কেউ কি বলতে পারে?
মহাশ্বেতা রায়
পেশাঃ ওয়েব ডিজাইনিং ও লেখালিখি
ভালবাসাঃ ইচ্ছামতী, ছোটদের জন্য বাংলা ত্রৈমাসিক ই-পত্রিকা
[ ১ম পাতায় ফেরত ] ...
বড় ভাল বলেছ হে! ঝরঝরে লেখাটি অকপট সত্যের অবতারণা করে ।
উত্তরমুছুনদারুণ একটা লেখা পড়ে গেলাম মহাশ্বেতার।
উত্তরমুছুনমেঘ
দারুন !
উত্তরমুছুনসবাইকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সর্বাগ্রে প্রাপ্য ইন্দিরাদির। উনি নিয়মিত জোর না দিলে আর লেখাটা হয়ে উঠত না।
উত্তরমুছুনkhub satyi bolechho. khub sundar lekha.
উত্তরমুছুন