পৃষ্ঠাসমূহ

১ এপ্রি, ২০১১

টুসিরে..


রাজা আর রাণী ওদের বাবা আর মায়ের নাম । খুশির সংসার । ওরা দুই বোন । আমি নাম দিয়েছি টুসি আর টুনি । । সারাটাদিন বালির ওপর খেলে বেড়ায় ওরা । কখনো পড়ে যায় । আবার খুনসুটি করে । মা এসে দু'ঘা দিয়ে যায় । পালিয়ে আমার কাছে চলে আসে । ঝুল ঝুল করে চেয়ে থাকে ওরা আমার দিকে । মায়ের ওপর অনেক অভিযোগ নিয়ে .. যেমন আজ মা খাবার বন্ধ করে দিয়েছে কিম্বা পাশের বাড়ির টমির মাংসের হাড়ে ভাগ বসিয়েছিলুম তাই মা নখ দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে । যত নালিশ আমার কাছে । আর আমাকে ব্ল্যাকমেল করে আজ দুধ-ভাত কাল কলা, পরশু ডিমের ডানলা-ভাত আদায় করে । খেয়ে দেয়ে চৌবাচ্চার নীচের ফুটো দিয়ে গড়িয়ে আসা জলে মুখ পুঁচে কাঁঠালগাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে । টুসি আর টুনির গায়ের রঙ কালো । বাবা মা কারোর মত হয়নি বলেই মা বাবার অত রাগ ওই দুটির ওপর । অন্ততঃ টুসির তাই বিশ্বাস । কিন্তু রঙ নিয়ে কি হবে ? টুসি আর টুনির চোখের ওপর দুটো ডিমের মত সাদা দাগ আছে । তাই আমার কেবলই গুলিয়ে যায় কে টুসি আর কে টুনি এই নিয়ে |একদিন দুটোকে কাছে দাঁড় করিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করলুম । দুজনেরই তেল চকচকে কালো লেজ  । চোখের ওপর তেরচা করে সাদা ডিম । দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ বিলকুল সমান । কিন্তু একজনের কালো লেজের আগাটা ধবধবে সাদা । ব্যস ! তাকে আমি  টুসি বলে মনে করে রাখলাম কারণ টুসির "স" ফর "সাদা" অথবা টুনির "ন" ফর "নেই" । কি জানি এই সাদা ল্যাজের আগার জন্য টুসিই বোধহয় আমার একটু বেশি এটেনশন পায় আজকাল ।  আমার সংসারে বাড়তি কলাটা, মূলোটা, পার্টির লেফটওভার, তরকারির ঝোল-আলু   আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে টুসিকে আসতে দেখলেই উঠোনে গিয়ে খাইয়ে আসি । টুনি সে কথা বুঝতেও পারেনা ।  আমি যে ইচ্ছে করে এমন পক্ষপাতিত্ব করি তা কিন্তু  টুসি বোঝে । আমি যখন পাশের দোকানে দুধ, পাঁউরুটি  কিনতে যাই সারাটা পথ ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আমার সাথে যায় আর যেতে যেতে কুঁই কুঁই করে কি সব বকে চলে । আমি ভাবি, কি জানি  খিদে পেয়েছে বোধ হয় । কিন্তু একদিন দেখি পেট ভরে খাবার পরও এমন আওয়াজ করছে  । নাঃ ! বুঝলাম এটা আমাকে আদরের বহিঃপ্রকাশ ।   
তা মন্দ লাগেনা আমার । মানুষের চেয়ে এরা অনেক ভালো বন্ধু হয় ...সে কথা সর্বজনবিদিত । তাই আমিও খুব প্রশ্রয় দি ওকে । কেবল ভাত পরিষ্কার করে না খেলে আর জল দিয়ে মুখ না আঁচালে তাকে একেবারে কচুকাটা করে বকুনি দি । একদিন দেখি বিকেলে টুসি বাইরে খুব ডাকছে । গিয়ে দেখি ওদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে বলে সকলের বাগানের চারিদিক দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হচ্ছে  । যাতে টুসি, টুনি রাজা রাণী কেউ আর বাগানে ঢুকতে না পারে । এখানে প্রত্যেকের কোয়ার্টারের সাথে লাগোয়া বাগান ও জমি আছে যেখানে টুসি-টুনিরা অহোরাত্র দাপিয়ে বেড়ায় মনের খুশিতে । সেদিন টুসিকে বললাম । তুই আর কোথাও যাস্‌না টুসি । আমার বাগানেই পড়ে থাক । টুসি ঘাড় ঘুরিয়ে টুনিকে দেখালো ।  আমি বললাম " এই বাজারে একটা টুসিই আমার থাক না " টুনি না হয় অন্য সংসারে যাক । তাতে দুজনেই ভাল থাকবি । ল্যাজ নাড়তে নাড়তে টুনি ওদিক দিয়ে পাশের বাড়ির বাগানের দিকে চলে গেল । বোধহয় মনে মনে বলে গেল " এ আর নতুন কথা কি! " আমি ঠিক জানতুম একদিন তুমি এমনটিই বলবে "  সেদিন আমার বিকেলের জলখাবারের এক প্লেট চাউমিন এনে টুসিকে দিলাম । টুসি  তো মহাখুশি । এখন বড় হচ্ছে, জিভের স্বাদ হয়েছে, মুখের তার বোঝে । ম্যাগি বোঝে, সস বোঝে, গোলমরিচের ঝাল বোঝে ।  


মাটনের হাড়ে সময় বেশী লাগে , চিকেনের হাড়ে সময় কম লাগে । খেলার তাড়া থাকলে মাংসটা কি পরখ করে দেখে নিয়ে চৌবাচ্চার আড়ালে রেখে চলে যায় । এসে আবার সময়মত খেয়ে নেয় । মাংস,মাছ যেমন খায় আমার উপোস, বারব্রতর  দিনে ফল , টকদৈয়ের ফলার দিব্যি খেয়ে নেয় চেটেপুঁটে । আমি মনে মনে বলি " সব কিছুর অভ্যেস  ছোট্ট থেকে করলে সব হয় " । যত বড় হচ্ছে টুসি  আমি তত‌ই অবাক হ‌ই ওকে দেখে আর বলি " ভগবান ! জল ঝড়, সাপ-খোপ, মৌমাছি-বোলতা সকলের হাত থেকে রক্ষা কোরো আমার টুসিকে"  বড্ড মায়া পড়ে গেছে আমার এই একরত্তি টুসির ওপর ! খুব বাধ্য টুসি আমার । আমার হাতে লাগানো সাতটা বেগুণ চারা, পাঁচটা লঙ্কাগাছ, একটা লাউ,  আর গোটা দশেক মোটে ভিন্ডি গাছ আছে । ওরাও টুসির মত ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠছে । প্রথম যখন চারা লাগাই দামাল টুসি-টুনি  একেবারে চেলে ফেলে দিয়েছিল বাগানটা। পরদিন ভোরে উঠে দেখি কোন চারাটা শুয়ে পড়েছে, কোনটা  বেঁকে গেছে আর ভিন্ডিতো অর্ধেকের ওপর  থেঁতলে গেছে । খুব বকুনি দিয়ে ছিলাম আর বলেছিলাম " একদম বের করে দেব্, আর কক্ষোনো খেতে দেব না ...কথা না শুনলে"  কি জানি তারপর থেকে টুসি-টুনিই কিন্তু আমার ঐ ছোট্ট রসুই-বাগানের পাহারাদার| ভুলেও ধারেকাছে যায় না ।  গা ঘেঁষে ধীরে ধীরে ঐটুকু বাগানের পাশ দিয়ে চলে যায় । বরং একটা দুষ্টু কাঠবেড়ালি  আছে তাকে পারলে দৌড়ে গিয়ে তাড়া করে সেখান থেকে বের করে দেয় ।  কাঠবেড়ালিটা সুযোগ পেলেই উপু হয়ে বসে তার বিশাল লেজটিকে শূন্যে  খাড়া করে দুহাত দিয়ে কুটুর কুটুর করে কচিপাতা আর বেগুণ গাছের গোড়ায় ছোটছোট পোকা খেতে যায় যে ! আর ঐ পোকা খাওয়ার নাম করে লাউগাছটার কচি ডগা, বেগুণ গাছের কচিপাতার মধ্যে ছোট্ট বেগুণি রঙের ফুলও খুঁটতে থাকে যে! ভারি রাগ ধরে টুসির তখন !  
 এখন অবিশ্যি শুধুই টুসিই আমার রসুই-বাগানের সর্বক্ষণের গ্রুপ ফোর সিকিউরিটি ।  আজ সকাল থেকেই কেমন গরম গরম লাগছিল । কাল বিকেলে একটু কালবোশেখি হয়ে গেল । তা সত্ত্বেও আজ রোদের তাপ জানান দিচ্ছে গরম পড়ে  গেল । ইতিমধ্যে টুসি আর টুনি খুব কায়দা করে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙোতে শিখেছে । আশপাশের গ্রাম থেকে  কেউ ওদের ত্রিসীমানায় এসে পড়লে তাকে তাড়িয়ে বাইরে বার করে দেওয়া অবধি লড়ে যায় ।    ক'দিন ধরে দেখছি খুব হাঁচছিল টুসি । কি জানি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে বোধ হয় জ্বর এসেছিল । কিচ্ছু খাচ্ছিলও না । রাণী এসে একটু  আদর করে দিয়ে গেল । রাজা এসে ক'টা গাছের পাতা রেখে গেল চৌবাচ্চার ধারে । বোধহয় বাচ্ছার অসুখ করেছে তাই ওষুধ । আমি ভাবলাম  এই সময়  এপ্রিল মাসে, সিজন চেঞ্জে  আমাদের বাচ্ছাদেরও তো খাওয়াদাওয়ায় অরুচি হয় তেমনটিই হয়েছে ।   আমি ভাবলাম দাঁত উঠেছে তো দাঁত সুলোচ্ছে । একটু কড়মড়ে কিছু দি টুসিকে । টুসি তাহলে ঠিক খাবে ।  পরিষ্কার করে ধোয়া  চৌবাচ্চার পাশটা খুব ঠান্ডা থাকে ।আজ ও ও শুয়েছিল সকাল থেকে । মনটা যেন খারাপ খারাপ । গান করছে না । কুঁইকুঁই করছে না । আমাকে দেখে ল্যাজ নাড়ছে না । একখানা মুচমুচে বিস্কুট আর একটা গরম স্লাইস ব্রেড টোস্ট করে ওকে দিয়ে এলাম । যেই মাত্র দেওয়া অমনি কচমচ করে খেয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলে যাচ্ছে আমি বললাম "কিরে মুখ আঁচালিনা জল দিয়ে? রোজ যেমন ধুস " তার কোনো বিকার নেই ।  
সেদিন ছিল পয়লা এপ্রিল ; আর তারপরই আমার খেয়াল হল অরে এতো টুসি নয় এতো টুনি ! আমাকে এপ্রিল-ফুল করলি তুই???  পরদিন মর্নিং ওয়াকে গিয়ে শুনলাম টুসিকে  ধরে নিয়ে গেছে ওরা.. বড়গাড়িতে করে লোহার  সাঁড়াশি নিয়ে যারা আসে আর পাঁচটা টুসিদের ধরতে ।  তক্ষুণি বুঝলাম আমার টুসিটা টুনির মত চালাক ছিলনা  | নয়ত এপ্রিল-ফুলের দিন টুনি আমাকে বোকা বানায় !  

৬টি মন্তব্য:

  1. Dear Indira
    AJ finally tomar parha-e ( I mean blog-basati te)elam, anek din par. Apurbo lekh hoechhe...as usual. Last para ta Porh-e, buk-e ar mon-e khocha laglo...
    I liked the humour part too...like S for Tusi ..and N for " S" Nei jar.
    Ebar dekhi ki ki miss korechhi gato 2 months-e
    Bhalo theko

    উত্তরমুছুন
  2. Dear Indira
    saw your comment above..I always thought , it was a great story on Tusi and Tuni and nothing real about it..Now I feel good that Tusi is back..

    উত্তরমুছুন