পৃষ্ঠাসমূহ

২২ ডিসে, ২০১০

অথ মৃচ্ছকটিকম্‌ -(ছোট গল্প)


রাত প্রায় দুটো। তিলোত্তমা মহানগরী ঢলে পড়েছে গভীর নিদ্রায়।  দ্বিতীয় হুগলী ব্রিজের ওপরে দুয়েকটা গাড়ি নিঃসাড়ে পার হচ্ছে গঙ্গা। গিয়ে ঢুকছে প্রশস্ত রাজপথে। রাস্তার দুপাশে  স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছে স্ট্রীট ল্যাম্প।    আকাশে প্রতিপক্ষের একসূতো চাঁদ। ঘোর অন্ধকারে চুঁইয়ে পড়ছে পথবাতির আলো। ছুটে চলেছে ইন্দ্রসেনা । পরণে নীল শিফন শাড়ি,  জমিতে হলদে বড়বড় ফুলের ছাপ  । একহাতে বেদের মেয়ের মত চুড়ির গোছা আর একহাত খালি । ফাইভস্টার হোটেলে কাজ করে ইন্দ্রসেনা। রিসেপশানিস্ট হয়ে ঢুকেছে; আজ তার এত দেরীর কারণ দেবদত্ত | দুজনার চলার পথে দু একবার দেখা হয়নি যে তা নয় কিন্তু আজকের আলাপ একটু অন্যরকম । গভীর তাত্পর্যপূর্ণ। অন্তত ইন্দ্রসেনার কাছে। আজ হোটেলে একটা বিরাট ককটেল পার্টি ছিল সেখানে দেবদত্তের সাথে একাধিকবার তার ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়েছে আর তারপর সব কিছু ওলটপালট । পার্টিতে উপস্থিত কেউ কেউ তাদের ঘনিষ্ঠতাও লক্ষ্যও করেছে।   পার্টিটা ছিল সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটদের উদ্যোগে এক বিরাট ফেস টু ফেস কমিউনিকেশন পার্টি,  বছর পাঁচেক ধরে সোশালনেটে বন্ধুত্বের দায়,সামাজিক দায়বদ্ধতা যারা এড়াতে পারেনি তাদের একটা বিশাল সমাবেশ হযেছিল এই হোটেলে আজ সন্ধ্যায়। দেবদত্ত সেই পার্টির প্রধান অর্গানাইজার | গুগল, ইয়াহু,  এই সব কম্পানির কর্ণধাররা প্রচুর  বিজ্ঞাপন দিয়েছে। একা দেবদত্তর ফ্রেন্ডলিস্ট থেকেই  হাজির হয়েছে প্রায় একশ জন, ইন্দ্রসেনাও আছে এদের মধ্যে।   আর দেবদত্তর বন্ধুর বন্ধুরাও আছে, আছে কিছু কমন বন্ধু যেমন ইন্দ্রসেনা।  ককটেল স্পনসর করেছে ট্যুইটার গ্রুপ আর ডিনার খাইয়েছে গুগলবাজ । লাকি ড্রও ছিল সেই সাথে,  ছিল সোনি ল্যাপটপ জেতার সুযোগ ।  
পাঁচবছর ধরে নেটালাপে ডিজিটাল ঘনিষ্ঠতা চলার পর আজ ছিল লক্ষ্যভেদের পার্টি, ইন্দ্রসেনা তাই ভাবে মনে মনে  ।  খাস কোলকাতার কেতার হোটেলের রিসেপশানিস্ট বলে কথা । ইন্দ্রসেনার রূপ যেন উথলে উঠেছিল সেই সন্ধ্যায় ।  যারা অর্কুট, ফেসবুক, টুইটারে নিজের পরিচয় গোপন করেনি তারা একে অপরকে দেখেই চিনেছে , উদ্বেলিত হয়ে কুশল বিনিময় করেছে, আনন্দের আতিশয্যে আটখানা হয়ে পড়েছে।
সারা সন্ধ্যা ধরে হোটেলের স্ফটিক কক্ষে চলেছে একে ওকে কোণ ঠাসাঠাসি, পা চাটাচাটি, ল্যাং মারামারি,  হিং লাগানো কথার মারপ্যাঁচ, পিঠচাপড়ানি ; কেউ  ফোকটে আকন্ঠ পানের ফোয়ারা ছুটিয়ে ঘুম দিয়েছে সোফায়, কেউ আদেখলার মত স্ন্যাক্স খেয়েই চলেছে  দফায় দফায় । ইন্দ্রসেনা বুদ্ধিমতী মেয়ে কিন্তু সরল ; ও লোককে বিশ্বাস করে ফেলেছে ।   দেবদত্ত আগে থেকেই বলে রেখেছিল তাকে যে, রাতে বাড়ি পৌঁছে দেবে । 
ইন্দ্রসেনা মনে মনে বলে "সদাশিব না? ওমা এত একটা বুড়ো"? প্রত্যয় না? এতো এক্কেবারে বাচ্চা ছেলে, ওমা অরূন্ধতী না? শুধু ছবি বদলায় আর কোনো কাজ নেই এর; আরে অনীশদা না? ইনি এত গম্ভীর? না দেখলে কে বলবে? ইনি সেই কবি না কি যেন নাম! শৌনক সেন মনে পড়েছে ; ইনি সেই শ্রুতিনাটক করেন, প্রায়ই এনার প্রোমো দেখি নতুন অনুষ্ঠানের,  এদের মধ্যে দেবদত্তর সাথে ইন্দ্রসেনার একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছে এই চার-পাঁচ বছরে। 
সকলে যেন গিলছে ইন্দ্রসেনাকে, যেন কোনোদিন মেয়ে দেখেনি এরা; কি নির্লজ্জ রে বাবা ! কি গায়ে পড়া । আরে সেই লোকটা না ? সেই লাস্ট ইয়ারে একে তো কমিউনিটি থেকে ব্যান করেছিল ফেসবুক । কি যেন অশ্লীল সব কমেন্ট করত বলে, একবার অর্কুটে তাড়া করেছিল ইন্দ্রসেনাকে,  তারপর আর ইন্দ্রসেনা অর্কুটে ছবি দিত না নিজের, নয় ফুল, নয় পাখি, নয় গাছ এভাবেই চলত।  "লোকটার কি নাম যেন দেব"? ইন্দ্রসেনা বলল | দেবদত্ত বলল  নাম তো আসল নয়, অমন নাম কি হয় কারো?  অর্কুটে অর্বাচীন, ফেসবুকে ফর্নাথিং, টুইটারে টেরিবল, আর গুগলবাজে  গ্যাঁড়াকল নাম এনার । নামকরণের বলিষ্ঠতা দেখে মনে হয় খুব ক্রিয়েটিভ পার্সন । আসলে হোপফুলি হোপলেস ইনি ।    ইন্দ্রসেনা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল ভেতরে ভেতরে । রাত বেড়ে চলেছে, কথার শেষ নেই, এক‌ই  মানুষজন পরিবৃত হয়ে একনাগাড়ে পার্টি চলছে তো চলছে, যেন ডিজিটাল জি-টক আজ  চাক্ষুষতায় পূর্নতা পেয়েছে। কেউ লগ আউট করছেনা, ইন্দ্রসেনা খুব ট্যাক্টফুলি নিজেকে সংযত রাখছে।দেবদত্তকে ইন্দ্রসেনা দেখতে পায় আর এক মহিলার সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে  । ইন্দ্রসেনা কি করবে বুঝতে পারেনা একবার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায় |
এতদিন সে ভেবে ছিল দেবদত্ত বুঝি বা তার একার সম্পত্তি;  অন্তত অর্কুট, ফেসবুক ট্যুইটার তাই বলে । কিন্তু এই মহিলা কে ? এনাকে তো কখনো দেবদত্তের বন্ধু তালিকায় দেখিনি । মনে মনে ভাবল ইন্দ্রসেনা । তাহলে কি অন্য কোনো ছদ্ম প্রোফাইলে আছেন এই মহিলা ?   ছি: দেবদত্ত,  তুমি আমাকে শেষে ঠকালে ? এতদিন আমার সাথে অভিনয় করলে প্রেমের ? আর পাঁচটা বন্ধুর থেকে আমি তোমাকে আলাদা ভাবতাম । আমি তোমার কথা বাড়িতে বলেছি । বাবা মা কে বিয়ের সম্বন্ধ করতে বাধা দিয়েছি ।  হঠাত হোটেলের সেই স্ফটিক কক্ষ যেন দমটা বন্ধ করে দিচ্ছিল ইন্দ্রসেনার  । নিজেকে মনে মনে বলল সে " এই জন্য অজ্ঞাতকুলশীলকে কখনো প্রশ্রয় দিতে নেই অন্তত প্রেম-বিয়ে এই সবের ব্যাপারে"   তার দাদা তাকে অনেক বার বলেছিল এ কথা । সাবধানও করেছিল । কিন্তু ঐ যে রোজকারের এই ইন্টারএকশান,  নিয়মিত চ্যাটালাপ, স্ক্র্যাপ তাদের ঘনিষ্ঠতা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে সে মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেছিল দেবদত্তকে ।

এদিকে দেবদত্তের ভরসায় সে এসেছে এখানে । সে ভাবতেই পারেনি কস্মিনকালে যে পুরো পার্টিটা তার বোনা স্বপ্নের জালকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে দেবে দেবদত্ত । এক চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ল সে ।  একে একে সব অচেনা পুরুষগুলো নেশা করে তার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে, কেউ ধরছে হাত, কেউ অশালীন ইঙ্গিত করছে ।ইন্দ্রসেনা একবার দেবদত্তকে ইশারা করে ডাকতে গিয়েও সরে এল । কিছু পরে দেবদত্তই নিজে এগিয়ে এসে তাকে নিয়ে গেল একজনের কাছে,"এই যে এই আমাদের মিস ইন্দ্রসেনা রয় আলাপ করুন এর সাথে " আর "ইনি মিস্টার ডিসুজা, ট্যান্ডেলিং গ্রুপ অফ হোটেলস এর মালিক"  বলে আলাপ করিয়ে দিল ইন্দ্রসেনার সাথে । ভদ্রলোকের ঘোলাটে চোখ আর চাকচিক্যময় পোশাক দেখে ইন্দ্রসেনার কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকল । এদিকে দেবদত্ত আলাপ করিয়ে দিয়েই পালাল সেখান থেকে । চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ল ইন্দ্রসেনা । ভদ্রলোক তার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে জিগেস করল " আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি আপনার মত একজনকে আমার গোয়ার রেসর্টে রিসেপশানে দেখলে খুব খুশি হব ।অশালীন ইঙ্গিত করল হোটেলের ঘরগুলি দেখিয়ে, বলল How much would you expect as your salary?" ইন্দ্রসেনা চকিতে বলল না, না আমার ফ্যামিলি এখানে, আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না" ভদ্রলোক তখন চেঁচিয়ে উঠল  "কি যাবেন না মানে ? আমাকে তো দেবদত্ত কথা দিয়েছে" আর দেবদত্তকে আমি তাই আমার বন্ধুর কোম্পানিতে ডাবল স্যালারিতে  চাকরি দিলাম । এই মাসের শুরুতেই সে মিডল‌-ইষ্ট চলে যাচ্ছে, নতুন কোম্পানি জয়েন করছে । ইন্দ্রসেনা বলল " কি মুশকিল আমি তো এসবের কিছুই জানিনা "    লোকটা তার সেলফোনের কললিস্ট থেকে দেবদত্তকে ফোন ঘোরাতে লাগল । 
এদিকে দেবদত্ত ততক্ষণে হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ষ্টার্ট দিয়েছে  । তার মোবাইলটি অফও করেছে মনে করে । ফোন সুইচ অফ দেখে লোকটা হোটেলের ক্রিষ্টাল রুমের দিকে এগোল  দেবদত্তকে খুঁজতে ; ততক্ষণে  ইন্দ্রসেনা ছুটে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে টয়লেটে গিয়ে মুখে চোখে ঠান্ডা জল দিয়ে হোটেলের বাইরে পা রেখেছে ।       বেরিয়ে পড়েছে  সেই অন্ধকার রাজপথে । আর কেবল মনে হতে লাগল মৃচ্ছকটিকমের নায়িকা বসন্তসেনার কথা । মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল, "চুলোয় যাক সোশালাইট করা,   হায়রে সমাজ, এখনো মানুষ হলনা তোমাদের সেই চারুদত্ত, ভগদত্তেরা" !!!  

৪টি মন্তব্য:

  1. গল্প তো গল্পই হওয়ার কথা।কিন্তু মাঝেমাঝে তাদের একএকটা
    প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়,যেন ভূমিকম্প দুলিয়ে দেয় পায়ের
    তলার মাটি।বুকটা মরুভূমির মতো শুকিয়ে যায়।প্রস্ন করি
    নিজেকে ,এরকম হলে কোথায় যাবো?নিজের হাতে গড়া
    একটা সুন্দর পৃথিবীকে হঠাৎ চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখলে বড়ো অসহায়
    লাগে।

    উত্তরমুছুন